মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার আধুনিকায়ন

মুসলিম বিশ্বে শিক্ষার আধুনিকায়ন

সাইয়েদ রাবে হাসানি নদভি ।। সভ্য মানুষের জন্য শিক্ষা তত প্রয়োজনীয়, শারীরিক সুস্থতার জন্য খাদ্য যত প্রয়োজনীয়। বর্তমান যুগে শিক্ষা খাতে পশ্চিমা বিশ্বের অভাবনীয় উন্নতি এবং বৈশ্বিক রাজনীতি ও ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব কারো কাছে অস্পষ্ট নয়। তাদের অগ্রযাত্রা দেখে প্রাচ্যের দেশগুলোতেও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ও তা ঢেলে সাজানোর তাগিদ তৈরি হয়েছে। প্রাচ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আধুনিক বিষয়ে পাঠদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং তা পাঠদানের জন্য পৃথক বিদ্যালয় গড়ে উঠছে। তবে এ কাজে বড় বিনিয়োগ, সর্বোত্তম ব্যবস্থাপনা এবং অধিকতর চিন্তা-গবেষণা প্রয়োজন। দুঃখজনক বিষয় হলো, মুসলিম বিশ্ব এখনো শিক্ষার আধুনিকায়নে যথেষ্ট মনোযোগী নয়। সময়ের দাবি হলো, এ বিষয়ে মুসলমানের সম্পদ ও শক্তি, মনোযোগ ও সচেতনতা, মেধা ও বুদ্ধিকে নিযুক্ত করা। বিশেষত, মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের বিশেষ মনোযোগ প্রয়োজন। তাদের আন্তরিক চিন্তা ও প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্ব তাদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারবে, ইনশাআল্লাহ!

কিছু ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র এমন, যারা ‘দ্বিনি ইলম’ (ধর্মীয় জ্ঞান) সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। জনসাধারণের সহায়তায় তাদের আর্থিক প্রয়োজন পূরণ হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে ইসলামী জ্ঞান ও বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা নিজ নিজ আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তার আলোকে পাঠদান করে থাকেন। দ্বিনি শিক্ষা বিস্তারে নিবেদিত এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় জ্ঞানে পণ্ডিত, জাতির পথপ্রদর্শক ও সংস্কারক তৈরি হয়, যাঁরা ইসলামী জ্ঞানের সংরক্ষণ ও সমাজে ধর্মীয় অনুশীলন বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে আসছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের একমুখী কার্যক্রম নিয়ে কিছু মানুষ আপত্তি করেন। কিন্তু তাঁদের আপত্তি যথাযথ নয়। সাধারণ ও আধুনিক কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও সার্বিক কার্যক্রম জ্ঞানের বিশেষ শাখায় সীমাবদ্ধ। যেমন—টেকনিক্যাল কলেজ, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কার্যক্রম একটি বিশেষ শাখায় সীমাবদ্ধ। তেমনি ধর্মীয় জ্ঞান তথা ফিকহ, কোরআন, হাদিস ও দাওয়াতি জ্ঞানের শিক্ষার জন্য, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শ্রেণি তৈরি করার জন্য কিছু বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ভুল নয়; বরং মুসলিম উম্মাহর দ্বিনি প্রয়োজন পূরণে তা আবশ্যকও।

অন্যদিকে যেসব ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুগের চাহিদা পূরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা উপকরণ ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর খরচ নির্বাহ করা কঠিন হয়ে যায়। এসব বিষয়েও মুসলিম সমাজের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশকিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তৈরি হয় সরকারি স্বীকৃতি নিয়ে। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সরকারি অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকারি অনুমোদন নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এসব প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করতে হিমশিম খেতে হয়। কেননা এর শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মূল্যবান অনেক উপকরণের দরকার হয়। এমন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার খরচ সাধারণ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার চেয়ে বেশি ব্যয়বহুল। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সরকার ও সচ্ছল মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। ফলে ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে মুসলিম নেতৃত্ব খুব বেশি অগ্রসর হয় না। অথচ মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতে সারা দেশে এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। শুধু সরকারি সহযোগিতা বা ধনীদের অনুদানের প্রতি তাকিয়ে না থেকে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যায়—এমন বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজে বের করাও আবশ্যক। কেননা জাতির ভবিষ্যৎ কোনো সরকার কিংবা জনগোষ্ঠী অনুদান-অনুগ্রহের ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না।

বিশেষত, যেসব দেশে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেসব দেশে নিজস্ব ব্যবস্থায় আধুনিক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বেশি প্রয়োজন। কেননা সরকার ভিন্ন ধর্মীয় হওয়ায় এবং মুসলিমরা সংখ্যালঘু হওয়ায় ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাই নিজেদের প্রয়োজন পূরণে সনির্ভরতা অর্জন করা আবশ্যক। যদি সরকার কোনো সহযোগিতা করে তাহলে তা গ্রহণ করবে। তবে সতর্ক থাকতে হবে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য বিনষ্ট না হয়। সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা জ্ঞান ও চিন্তায় মুসলিম উম্মাহর বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

বৈশ্বিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে যারা দ্বিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন তাদের প্রতি নিবেদন, শুধু সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য প্রতিষ্ঠান না করে জাতীয় স্বার্থ, সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠান করুন। যেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ময়দানে মুসলিম জাতির উন্নয়নে প্রতিটি শিক্ষার্থী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। মুসলিম জাতির প্রয়োজন ও অগ্রগতিকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সফল ও ফলপ্রসূ করে তোলার ক্ষেত্রে পাঠদান পদ্ধতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষক জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখেন, তিনি পাঠ্যপুস্তক পড়িয়েই থেমে যান না। তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পাঠদানের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ভেতর আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন।

আধুনিক ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় জটিলতার একটি দিক হলো পাঠ্যক্রম। প্রতিষ্ঠান সরকারের স্বীকৃতি গ্রহণ করলে, সরকারি তালিকাভুক্ত হলে সরকার একটি পাঠ্যক্রম আবশ্যক করে দেয়, যা সম্পন্ন করতে গেলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে যায়। সরকারি পাঠ্যক্রম অক্ষুণ্ন রেখে শিক্ষার্থীদের মন-মস্তিষ্কে ইসলামী শিক্ষার বীজ রোপণ করা যায় সে চিন্তা করতে হবে। মুসলিম বিশ্বের দুর্ভাগ্য হলো ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব এখনো মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা ক্ষেত্রের নীতিনির্ধারক ঔপনিবেশিক শাসনের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ফলে উম্মাহর চিন্তা, জাতীয় স্বার্থ ও আগামী দিনের সুরক্ষার বিষয়গুলো তাদের চিন্তা ও কাজে প্রতিফলিত হয় না।

পরিশেষে বলতে চাই, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দানকারীদের জন্য আবশ্যক হলো জ্ঞানের উন্নয়ন ও প্রশস্ত পথের অনুসরণ করা। যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ ধরে মানুষের জাগতিক জীবনের উন্নতি ঘটছে তা উপেক্ষা না করে, নতুন সৃষ্ট প্রশ্নের সমাধানে এগিয়ে আসা এবং আধুনিক শিক্ষাকার্যক্রমের সঙ্গে সমতা বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া। সময়ের স্রোতধারায় যেন মুসলিম জাতি পিছিয়ে না পড়ে সে জন্য সচেতনতা তৈরি করা। এ ক্ষেত্রে তারা মধ্যযুগের ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনকে সামনে রাখতে পারে। যখন মুসলিম জ্ঞানী, বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতরা শুধু মুসলিম বিশ্বকেই আলোকিত করেননি; বরং তারা ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানগত বন্ধ্যত্ব ও অন্ধকার দূর করতে অনন্য ভূমিকা পালন করেন।

তামিরে হায়াত থেকে
আতাউর রহমান খসরুর ভাষান্তর