একটা সংবাদ সম্মেলন, পুরো পৃথিবীর কান্না!
মান্না চৌধুরী, ক্রীড়া সাংবাদিক || মেসির কান্না তো নতুন কিছু নয়। প্রায় দেড় যুগের ক্যারিয়ারে চোখের জলে ভাসা-ই যার নিয়তি! একেকটা বিশ্বকাপ, কোপা, চ্যাম্পিয়নস লীগ শেষে চিরকালীন দুঃখ, হতাশার মেসিই আবিস্কার হন মিডিয়ায়। কিন্তু ৮ আগস্ট যে মেসিকে দেখলো বিশ্ব সেটিতে মিশে থাকলো কেবল আবেগ আর ভালোবাসা। কেতাদুরস্ত মেসি টেবিলে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন, সামনে থাকা সবার চোখেই জল, বার্সেলোনার সীমানা ছাড়িয়ে এই কান্না ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে। এ যেন একটা সংবাদ সম্মেলন, পুরো পৃথিবীর কান্না!
আর্জেন্টিনা কিংবা বার্সেলোনার জার্সিতে মেসির হতাশার দিনগুলিতে কারও কারও মুখে হাসি, বিদ্রুপের হাসি! কিন্তু কাল আবেগী মেসির ছবি দেখে, বারবার টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মুছতে থাকা মেসিকে দেখে তাঁর নিন্দুক, সমালোচকদের চোখেও জল। এতদিন প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে থাকা সান্তিয়াগো বার্ন্যাব্যুর সার্জিও রামোস, কাসেমিরো, করিম বেনজেমারাও হয়ত বিখ্যাত এলএমটেন এর কান্না দেখে নিজেদের সামলে রাখতে পারেননি।
চোখের জলে ভিজেছেন মেসির একসময়ের বার্সা সতীর্থ কার্লোস পুয়োল, জাভি হার্নান্দেজ। দুজনই ছিলেন সংবাদ সম্মেলন কক্ষে। বন্ধুর হৃদয়ের রক্তকরন ছুয়ে গেছে জেরার্ড পিকে, সার্জিও বুসকেটস, জর্ডি আলবাদেরও। সবমিলিয়ে ক্যাম্প ন্যুর ভেতরে তৈরি হয় এক আবেগমাখা করুন পরিবেশ। যে মাঠে বার্সেলোনার সুখের সব দিন থরে থরে সাজানো সেই বিখ্যাত ন্যু ক্যাম্পে এমন নিস্তব্ধ, এমন শোকাবহ পরিবেশ কখনো তৈরি হয়েছে বলে শোনেনি কেউ।
তবে সবকিছুরই তো একটা শেষ আছে। আবেগ, ভালোবাসাও চিরস্থায়ী কিছু নয়। একটা সময়জুড়ে হয়ত মায়াজালে আটকে থাকা যায়। কিন্তু যখন সময় হয় বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার তখন যেদিকে চোখ যায় চলে যেতে হয়। লিওনেল মেসি যাওয়ার সময় রবি ঠাকুরের সেই গান ধরলেন কিনা কে জানে- 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে'! অনেকদিন ধরেই ডাকছেন। কখনো নরম সুরে আবার কখনো গলার আওয়াজ বাড়িয়ে।
আওয়াজ তোলার একটাই কারণ, তাঁর প্রিয় দল বার্সেলোনা যে সোনালী অতীত হারিয়ে ক্রমেই বিবর্ণ, হারতে হারতে গৌরব, ঐতিহ্যে টান পড়ার অবস্থা। লিওনেল মেসি নামের সঙ্গে এমন অপমান, ওমন লজ্জার হার যে একেবারেই বেমানান। পুয়োল, জাভি, ইনিয়েস্তা, সুয়ারেজবিহীন বার্সাকে আর কত একা টানবেন? ফুটবল এগারোজনের খেলা। রক্ষন থেকে আক্রমনভাগ মিলিয়ে যদি একটা বুঝাপড়া তৈরি না হয়, কয়েকজনের সাপোর্ট যদি না মিলে তবে ফল বের করা কঠিন। বর্তমান বার্সেলোনা অনেকটাই মেসিনির্ভর।
লিও জ্বললে ন্যুক্যাম্প, সান্তিয়াগো বার্নাব্যু কিংবা এস্তাদিও রামোন সানচেজ পিসওয়ানে জ্বলে বার্সেলোনার বাতি। তিনি নিস্প্রভ মানে ঘরের মাঠেই দুর্বল এইবার কিংবা এস্পানিওলের সঙ্গে হার! গতি, স্কিল, বাঁ পায়ের জাদু মিলিয়ে মেসি হয়তো বিশ্বসেরা ফুটবলার। কিন্তু দিন শেষে তিনিও তো একজন মানুষ। যিনি আজ জ্বলবেন, কাল হয়তো তাঁর ছায়া হয়ে থাকবেন। ছায়া হয়ে থাকার দিনে বার্সায় তো এমন কেউ নেই যে জয়ের তরীটা ভাসাবেন। নেই বলেই লা লীগায়, চ্যাম্পিয়নস লীগে জুটে চার গোল, আট গোলের লজ্জার হার! মেসি এসব মানতে পারেন না বলেই প্রতিবাদী হয়েছেন। দলকে নতুন করে সাজানোর সুর তুলেছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
অথচ মেসি-বার্সেলোনা মাখামাখি কি হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসার। কিশোর বয়সে গ্রোথ হরমোনের সমস্যায় জীবনটাই যখন সংকটে তখন বার্সা বাড়ায় সহযোগিতার হাত। আর্জেন্টিনা থেকে বাবার সাথে স্পেনের বার্সেলোনায় চলে আসেন ১৩ বছরের লিওনেল। চুক্তিতে দেরি হলে যদি ছুটে যায় শিকার! তাই কাগজ,টাগজের দরকার নেই, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়েই সই করিয়ে নাও। ন্যাপকিনেই সাইন করিয়ে নেন বার্সার তখনকার টেকনিক্যাল সেক্রেটারী চার্লস রেক্সাস! শুরু হয় বিখ্যাত স্প্যানিশ ক্লাবের সঙ্গে জীবন সংকটে পড়া এক কিশোরের ভালোবাসার গল্প। দায়িত্ব নিয়ে মেসির ইনজেকশনের পেছনে মাসে খরচ হওয়া এক হাজার পাউন্ড দেয় বার্সেলোনা।
নতুন জীবন পেতে দেশ,মহাদেশ ছেড়ে আসা মেসি একা থাকেন কি করে? পরিবারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয় বাবা থাকবেন ছেলের সঙ্গে। মেসির বাবার জন্য বছরে ৪০ হাজার পাউন্ডও ব্যয় করে স্প্যানিশ জায়ান্ট। মেসিও কি কম প্রতিদান দিলেন?
বার্সেলোনার হয়ে জিতেছেন সম্ভাব্য সব শিরোপা। ক্লাবটি নিজেদের ইতিহাসে পাঁচ চ্যাম্পিয়নস লীগের চারটিই জিতেছে মেসির সেরা ফর্মে থাকার সময়ে। লা-লীগা, কোপা দেল রে, ক্লাব কাপ, সুপার কোপা মিলিয়ে বার্সার হয়ে ৩৫ শিরোপার দেখা পেয়েছেন আর্জেন্টাইন সুপার স্টার।বার্সেলোনার ২৬ লীগ শিরোপার দশটিতে আছে মেসির স্পর্শ। প্রিয় দলের হয়ে সবমিলিয়ে করেছেন ৬৩৪ গোল! রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এল ক্লাসিকোতে রেকর্ড ২৬ গোল করে নিজেকে তুলেছেন অনন্য উচ্চতায়।
পেপ গার্দিওলার সঙ্গে জুটি বেঁধে বার্সেলোনাকে এমন অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিলেন, দুইবার ত্রিমুকুট, একবার এক মৌসুমে কাঙ্খিত ছয় শিরোপার ছয়টিই জিতেছেন! এই বার্সেলোনা শেষপর্যন্ত ছেড়ে যেতে হলো মেসিকে। ছাড়তে চেয়েছিলেন এক বছর আগে, বার্সা ম্যানেজম্যান্টের ওপর ত্যক্তবিরক্ত হয়ে। প্রায় সবকিছুই যখন চুড়ান্ত নাটকে নাটকীয় মোড় তখনই। মেসি থেকে গেলেন বার্সার ডেরায়। থেকে গিয়ে আজন্ম ঋণে মায়া বাড়ে মেসির। বার্সলোনায় থাকতে, বার্সেলোনাকে নতুন করে সাজাতে নিজের বেতনের ৫০ ভাগ ছাড় দিতেও রাজি ছিলেন ফুটবল জাদুকর!
কিন্তু ছাড়টারেও ফাটল তৈরি হওয়া সম্পর্কে আর জোড়া লাগেনি। মেসি তাই বাধ্য হয়েই বলে দেন বিদায়। তবে এই ছোট্র শব্দটা বলতে গিয়েই তাঁর জীবনের কঠিন পরীক্ষা। বিদায় বলার আগেই যে চোখ জুড়ায় অশ্রুপাত। স্বামীর আবেগের মাত্রা বুঝতে পেরে সামনে বসা স্ত্রী আনাতেল্লি রুকুজ্জো এগিয়ে দেন টিস্যু পেপার। যে ন্যাপকিনে ফুটবল ইতিহাস রাঙানো সম্পর্কের শুরু সেটিতেই চোখ মুছতে মুছতে ২১ বছরের আবেগ, ভালোবাসার শেষ! লিওনেল মেসি এখন পিএসজি না ম্যানসিটির? অপেক্ষায় থাকুন।