মন্তব্য প্রতিবেদন

রক্ত দিয়ে কেনা এই সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিচ্ছি না তো?

রক্ত দিয়ে কেনা এই সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিচ্ছি না তো?

যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের প্রাণবন্ত গণতন্ত্রে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা অপরিহার্য। তারা সরকারের ক্ষমতার উপর একটি নিরীক্ষক হিসাবে কাজ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। জনমত ও জনসমর্থন বৃদ্ধির মাধ্যমে তারা পুনরায় সরকার গঠনের চেষ্টা করে। তবে নির্বাচনের সময়ে এসে বিদেশী সংস্থা বা কূটনীতিকদের সাথে আলোচনায় বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ সর্বদা লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। যদিও তারা ক্ষমতায় আসার বিষয় মাথায় রেখেই এসকল বিদেশী ও উন্নত দেশের কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং দুই পক্ষের নানা রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়েও আলোচনা করে। এসবের মাধ্যমে তারা যে নিজ দেশের জন্য খাল কেটে কুমির আনার মতো অবস্থা তৈরি করছে কিনা সে বিষয়ে তারা ভ্রূক্ষেপও করে না। 

নির্বাচন সংক্রান্ত বিদেশী সংস্থা বা কূটনীতিকদের সাথে বিরোধী দলগুলির বৈঠকের প্রাথমিক উদ্বেগের মধ্যে থাকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা। যেকোনো সার্বভৌম দেশের মতো বাংলাদেশেরও স্বাধীনভাবে তার অভ্যন্তরীণ বিষয় ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া পরিচালনা করার অধিকার রয়েছে। যখন বিদেশী সংস্থাগুলি এই প্রক্রিয়াগুলিতে হস্তক্ষেপ করে, তখন এটি জাতির স্বায়ত্তশাসন এবং তার গণতান্ত্রিক নীতিগুলিকে সমুন্নত রাখার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। শুধুমাত্র এই অবস্থা বাংলাদেশের জন্য এমন নয়। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কথিত রুশ হস্তক্ষেপের দ্বারা সৃষ্ট জাতীয় সার্বভৌমত্বের হুমকির বিষয়টি এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে। সে সময়ের এই হস্তক্ষেপের অভিযোগ আমেরিকান নির্বাচনী ব্যবস্থার অখণ্ডতা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করে এবং মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্ককে উত্তেজিত করে এবং কিভাবে বিদেশী সম্পৃক্ততা একটি দেশের সার্বভৌমত্বকে ব্যাহত করতে পারে তা নির্দেশ করে।

নির্বাচনের সময় বিদেশী সংস্থা বা কূটনীতিকদের সাথে জড়িত থাকা অসাবধানতাবশত রাজনৈতিক মেরুকরণকেও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধকে আন্তর্জাতিক সংঘাতে রূপান্তরিত করতে পারে। বিদেশী সমর্থন চাওয়া বিরোধী দলগুলি অজান্তেই পূর্ব-বিদ্যমান বিভক্তিকে তীব্র করে তুলতে পারে, যা সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ সমাধানের পথকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলতে পারে। ২০১৪ সালের ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেখিয়েছিল বিদেশী সম্পৃক্ততা কীভাবে সংঘাত বাড়াতে পারে । রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে, ইউক্রেনের বিরোধীরা পশ্চিমা দেশগুলির সমর্থন চেয়েছিল, যার ফলে রাশিয়ার সাথে উত্তেজনা বেড়েছিল। এই বিদেশী হস্তক্ষেপের ফলে শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ক্রিমিয়াকে সংযুক্ত করে এবং পূর্ব ইউক্রেনে একটি স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হয়, যা দেশীয় বিরোধকে আন্তর্জাতিকীকরণের পরিণতি তুলে ধরে।

বিদেশী এজেন্সি বা কূটনীতিকদের সাথে জড়িত বিরোধী দলগুলি কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক আস্থা নষ্ট করার ঝুঁকিকেও বৃদ্ধি করে। এই ধরনের মিথস্ক্রিয়াকে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এটি কূটনৈতিক উত্তেজনা তৈরি করে যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগে রাশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন রয়েছে। হস্তক্ষেপের অভিযোগে রাশিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা এবং আস্থার অবনতির দিকে পরিচালিত করেছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াগুলিতে বিদেশী জড়িত হওয়ার আরো একটি পরিণতি প্রদর্শন করে।

নির্বাচনের বিষয়ে বিরোধীদল যখন বিদেশী সংস্থা বা কূটনীতিকদের সাথে জড়িত হয়, তখন দেশের জনগণও বুঝতে পারে এইদল সরকার গঠন করলে বিদেশী শক্তির দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত হবে, এবং জনগণ নয় বরং এসব সংস্থা বা কূটনীতিকদেরকে সন্তুষ্ট রেখে কাজ করার জন্য তাদের নিকট দায়বদ্ধ থাকবে। এবস্থায় বিরোধী দলগুলোর ভাবমূর্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয় এবং জনগণের সমর্থন আদায় করা তাদের পক্ষে কঠিন করে তোলে। ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট বিদেশী সরকার, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জড়িত বিরোধী নেতাদের চ্যালেঞ্জগুলিকে তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্ত্বেও, জুয়ান গুয়াইদো একটি বিদেশী পুতুল হওয়ার সন্দেহ এবং অভিযোগের সম্মুখীন হন, যা দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ অশান্তি এবং অনিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত করে।

সম্প্রতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিরোধীদলগুলির বিদেশী সংস্থা বা কূটনীতিকদের সাথে সাক্ষাতের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়েই আমাদের এই দীর্ঘ আলোচনা । দেশের সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার গঠন শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল নয়, সকল নাগরিকেরও একান্ত চাওয়া। তবে রাজনৈতিক দলগুলিকে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সমগ্রদেশকে, দেশের জনগণকে এমনকি দেশের সার্বভৌমত্বেকে অন্যদের কাছে বিকিয়ে না দেয়।  যদিও বিদেশী সংস্থার সাথে সম্পৃক্ততা আমাদের মতো উন্নয়নশীলদেশ গুলোকে নানান সহায়তা প্রদান করতে পারে, তবে দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং গণতান্ত্রিক অখণ্ডতা রক্ষা করে সতর্কতার সাথে চলা আবশ্যক। দেশের গণতান্ত্রিক এই যাত্রা এখন পুরোপরি নির্ভর করছে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের প্রজ্ঞার ওপর, পারবেন কি তারা কয়েক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা আমাদের এই সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখতে?