সিলেটে অতিবৃষ্টিতে ধসে পড়ে টিলা, প্রশাসনের সতর্কবার্তা আমলে নেন না কেউ

সিলেটে অতিবৃষ্টিতে ধসে পড়ে টিলা, প্রশাসনের সতর্কবার্তা আমলে নেন না কেউ

গেল কয়েকদিন ধরে সিলেটে বৃষ্টি হয়েছে। টানা ও ভারি বর্ষনে বিভিন্ন স্থানে ধসে পড়েছে টিলা। ঘটছে প্রাণহানী। গেল এক সপ্তাহে সিলেট বিভাগে অতিবৃষ্টিতে টিলা ধসে একজনের প্রাণহানী ও অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন। মাটি চাপা পড়েছে বেশ কয়েকটি বসতঘর। এতো দুর্ঘটনার পরও টনক নড়ছে না টিলার পাদদেশে বসবাসকারীদের। মৃত্যু ঝুঁকিও সরাতে পারছে না তাদের। টিলা ধসে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এমন সতর্কবার্তা দিয়ে যাচ্ছে প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। তবুও ঝুঁকিপূর্ণ বসতি ছেড়ে কেউ সরছেন না, এমনটা জানিয়েছে প্রশাসন।

সিলেটজুড়ে রয়েছে পাহাড়-টিলা। জেলার ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টিতে রয়েছে উঁচু টিলা। সিলেট মহানগরীতেও রয়েছে বেশ কিছু উঁচু টিলা। মাটি কেটে সমতল করে এসব টিলার পাদদেশে গড়ে তোলা হয়েছে বসতি। কোথাও টিলার মালিক মাটি কেটে অসহায় বাস্তুহারাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মূলত টিলায় নিজেদের দখলদারিত্ব টিকিয়ে রাখতেই মালিকরা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন। আবার কোথাও টিলা কেটে তৈরি করা হয়েছে আবাসন। অপেক্ষাকৃত স্বল্প মূল্যে কেউ কেউ টিলার পাদদেশে জায়গা কিনে গড়ে তুলেছেন বাসা-বাড়ি। প্রতিবছর বর্ষায় টিলা ধসে ঘটে প্রাণহানী। এবছর অন্যবারের চেয়ে টিলাধসের ঘটনা ঘটছে বেশি।

গত ৭ অক্টোবর টিলা ধসে শহরতলীর খাদিম চা বাগান এলাকায় এক শিশু মারা যায়। অতিবৃষ্টিতে ৬ অক্টোবর রাতে খাদিম চা বাগানের বস্তি লাইন এলাকায় টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। টিলা ধসে চা শ্রমিক বুলবুল ছত্রির ঘর চাপা পড়ে। এতে মাটি চাপা পড়ে মারা যায় বুলবুল ছত্রির মেয়ে অর্চনা ছত্রী (১১)। ৭ অক্টোবর ভোরে জৈন্তাপুর উপজেলার চিকনাগুল ইউনিয়নের পূর্ব সাতজনি গ্রামে টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। এতে আদিবাসী লেদই পাত্র, সুদেন পাত্র ও রণ পাত্রের বসতঘর মাটি চাপা পড়ে। এর আগে গত বছরের ৬ জুন জৈন্তাপুর উপজেলায় টিলা ধসে একই পরিবারের চারজন নিহত হয়েছিলেন। একই দিন সিলেট মহানগরীর আখালিয়া এলাকায় দুটি স্থানে টিলা ধসের ঘটনা ঘটে। টিলার মাটি ধসে বসতঘর ভেঙ্গে পড়ে। ৬ অক্টোবর নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের বনগাঁও গ্রামের মিরটিলা ধসে তিনটি বসতঘর বিধ্বস্ত হয়। মাটি চাপা পড়ে আহত হন তিন পরিবারের ১০ জন। এছাড়া গত ১৪ মে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ল²ণাবন্দে টিলাধসে অপু পাল নামের এক যুবক মারা যান।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিলেট মহানগর ও সদর উপজেলায় রয়েছে প্রায় ২শ’ টিলা। এছাড়া জেলার দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাট  উপজেলায় রয়েছে ছোট বড় প্রায় চারশ’ পাহাড়-টিলা। এসব টিলার অধিকাংশ কেটে বসতবাড়ি তৈরি করা হয়েছে। টিলার মালিকরা মাটি বিক্রি করে পাদদেশে তৈরি করেছেন বসতবাড়ি। কেউ স্বল্প মূল্যে ভাড়া দিচ্ছেন এসব ঘর। আবার কেউ প্লট তৈরি করে বিক্রি করে দিয়েছেন। বেশিরভাগ প্লটের ক্রেতা নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। ফলে নিরাপদ আশ্রয়ে বসতি করার সুযোগ না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই টিলার পাদদেশে তারা বসবাস করছেন।

সিলেট নগরের হাওলাদারপাড়া এলাকার একটি টিলার নাম জগো টিলা। উঁচু এই টিলার একেবারে কিনারা ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে কয়েকটি ঘর। ওপরের ঘরগুলোর ঠিক নিচে, টিলার পাদদেশেও ঘর রয়েছে কয়েকটি। টিলার ওপরে ও ঢালে বসবাস করা সব পরিবারের বাসিন্দাই রয়েছেন ঝুঁকিতে। প্রাণের শঙ্কা নিয়েই বছরের পর বছর ধরে তারা বসবাস করে আসছেন এখানে।

জাগোটিলার ওপর ঘর বানিয়ে বাস করা সুব্রত দাস বলেন, ‘এটি সরকারি টিলা। ভাড়া দিতে হয় না। তাই আমরা এখানে ঘর বানিয়ে থাকি। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাই ঝুঁকি নিয়েই এখানে পরিবার নিয়ে থাকতে হয়।’

ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’র প্রধান নির্বাহী আবদুল হাই আল হাদী বলেন, ‘আমরা কয়েক বছর আগে একটা জরিপ চালিয়ে দেখেছিলাম টিলার পাদদেশে প্রায় ১০ হাজার পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছেন। এখন এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।’ তিনি বলেন, ‘বসবাসের জন্য এসব টিলার অনেকাংশ কেটে ফেলায় টিলাগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এগুলো ধসে পড়ে প্রাণহাণির ঘটনা ঘটে।’

টিলার নিচে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকা লোকজনকে সতর্ক করা হচ্ছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান জানান, ৪ অক্টোবর বৃষ্টি শুরুর পরই আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেয়েই ঝুঁকিপূর্ণ আবাসনে অবস্থানকারীদের সতর্ক করা শুরু হয়। যেসব এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে টিলার নিচে লোকজন বসবাস করছেন সেসব এলাকায় মাইকিং করা হয়। এখনো মাইকিং চলছে। এছাড়া এসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করছেন। ঝুঁকিপূর্ণ টিলাগুলোতে সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডও লাগানো হয়েছে। এরপরও ঝুঁকিপূর্ণ বাসস্থান ছেড়ে লোকজন নিরাপদে আসতে চাইছে না।