ইসি গঠনের বিল সংসদে উঠছে আজ

ইসি গঠনের বিল সংসদে উঠছে আজ

নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে রোববার (২৩ জানুয়ারি) জাতীয় সংসদে উত্থাপন হবে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল-২০২২’। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি সংসদে উত্থাপন করবেন। সংবিধানের আলোকে আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে গত ১৭ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

১৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে একটি বিধান আছে। যেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিতে পারেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ আইন করা হচ্ছে।

ওইদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও জানান, আইনের খসড়ায় আছে—প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিতে একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে এ সার্চ কমিটি হবে। এ কমিটির দায়িত্ব ও কাজ হবে যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশ করা। ছয় সদস্যের এ সার্চ কমিটির প্রধান হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের এক জন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের এক জন বিচারপতি, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সার্চ কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের নাম সুপারিশের পর সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে নিয়ে একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে এবং এ বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধান সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগ দেবেন।’

সংবিধানে সুস্পষ্ট একটি অনুচ্ছেদ থাকার পরও কোনো সরকারই আইন করার উদ্যোগ নেয়নি। সম্প্রতি সুশীলসমাজসহ বিভিন্ন ফোরাম থেকে আইনটি প্রণয়নের দাবি জোরদার হয়। সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন ছাড়াও দেশের বিশিষ্টজনেরাও ইসি গঠনে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানান। নতুন ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যেই ২৫টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাতেও বেশির ভাগ দল আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলছেন, কোনো আইনের খসড়া অনুমোদনের পর আইন মন্ত্রণালয়ে কিছু কার্যক্রম থাকে। এরই মধ্যে সেসব কার্যক্রম শেষ করে আনা হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেন, আইনের খসড়াটি যেন আগামী রোববার সংসদে উত্থাপন করা সম্ভব হয়— আইনমন্ত্রী নিজেই এ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তদারকি করছেন। আজ মঙ্গলবারও (১৮ জানুয়ারি) এ সংক্রান্ত ফাইলের খুঁটিনাটি মন্ত্রী দেখেছেন।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, আমরা আগামী রোববার জাতীয় সংসদে এই আইনটি উত্থাপনের জন্য কাজ করছি। সংসদে বিল আকারে উত্থাপনের পর সেটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হবে। তাদের কোনো পর্যবেক্ষণ থাকলে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে তারপর ওই বিল পাস করার মাধ্যমে আইনটি চূড়ান্ত হবে। এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একাদশ জাতীয় সংসদের চলতি ষোড়শ অধিবেশনেই ইসি গঠন আইনটি পাস করা সম্ভব হবে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে আইমন্ত্রী বলেন, চলতি অধিবেশনেই নির্বাচন কমিশন গঠন আইন পাস করা হবে— এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী।

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। ফলে ওই সময়েই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে এই কমিশন গঠনের এখতিয়ার দেওয়া হলেও এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সেটি করার বিধান রয়েছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্বাচন কমিশন গঠন সংক্রান্ত সেই আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। ফলে রাষ্ট্রপতি নিজ এখতিয়ারেই নির্বাচন কমিশন গঠন করে আসছেন। তবে এর আগের দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। এরপর সেই সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন।

এবারেও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আইনটি প্রণয়ন করা সম্ভব হবে না বলেই জানিয়ে আসছিল সংশ্লিষ্ট মহল। একটি আইন প্রণয়নের জন্য যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা অনুসরণ এবং বছরের প্রথম সংসদ অধিবেশনটি যেহেতু সংক্ষিপ্ত হয় বলে এই সময়ের মধ্যে আইনটি প্রণয়ন করা অত্যন্ত কঠিন বলে একাধিকবার জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী নিজেও।

এর মধ্যে ইসি গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির সংলাপ শুরু হলে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে ইসি আইন প্রণয়নের জোর দাবি ওঠে। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এ-ও জানানো হয়, সরকার বললে তারা দায়িত্ব নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেও আইনটি প্রণয়নের কাজগুলো করে দেবে। এর মধ্যেই রাষ্ট্রপতির সংলাপে নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ব্রিফিংয়েই আভাস পাওয়া যায়— আইনটি হয়তো চলতি অধিবেশনেই পাস হবে।

আওয়ামী লীগও ইসি গঠন আইন চায় জানালে ওবায়দুল কাদেরের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়— নতুন ইসি নতুন আইনের অধীনে হবে কি না? জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, যেকোনো আইন পাস হওয়ার যে প্রক্রিয়া তার সব ধাপ অনুসরণ করেই এই আইনটিও পাস করা হবে। সরকারের হাতে বিকল্প কোনো পদ্ধতি বা ম্যাজিকের তাস নেই যে এটি রাতারাতি পাস করা সম্ভব হবে।

চলতি অধিবেশনেই ইসি গঠন আইনটি পাস হবে কি না— ফের এই প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘কাম অ্যান্ড সি, নাথিং ইজ ইম্পসিবল। যেহেতু এটি জনদাবি, সর্বাত্মক প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।’

কেমন হবে ইসি আইন
বহুল আলোচিত ও দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নির্বাচন কমিশন গঠন আইনের খসড়ায় সোমবার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের এই আইনের খসড়ায় সার্চ কমিটি গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে।

মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, আইনটি খুব ছোট একটি আইন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার জন্য রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়েই একটি অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠনের কথা বলা আছে। কমিটি এসব পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদের (সুইটেবল ক্যান্ডিডেট) নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ (রেকমেন্ড) করবে।

আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তাদের বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে। বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৫০ বছর। সরকারি-আধাসরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা করতে হবে। তবে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে কোনো নারী সদস্যকে রাখার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি খসড়ায়।

অযোগ্যতা প্রসঙ্গে এতে বলা হয়েছে, কোনো আদালতের মাধ্যমে অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত হলে, দেউলিয়া ঘোষণার পর দায়মুক্ত না হয়ে থাকলে, প্রচলিত নিয়মের বাইরে অন্য কোনো রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নিলে কিংবা অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার পদে নিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এছাড়া নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ফৌজদারি আইনে দুই বছরের সাজা হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কখনো দণ্ডিত হলে কিবা প্রজাতন্ত্রের লাভজনক কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও নির্বাচন কমিশনের সদস্য হওয়া যাবে না।

আগের নির্বাচন কমিশনগুলোর সুরক্ষা দেওয়ার বিধানও এই খসড়ায় রয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। সে অনুযায়ী সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত যে ১২ জন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও ২৭ জন নির্বাচন কমিশনার দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা এই আইনের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন বলে বিবেচিত হবে।

ইসি গঠন আইনের খসড়া বলছে, কেউ একবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে পূর্ণ মেয়াদে দায়িত্ব পালন করলে আর দ্বিতীয়বার একই দায়িত্ব পাবেন না। তবে কেউ আগে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করলে তিনি পরবর্তী সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

এই আইনের অধীনে রাষ্ট্রপতি নতুন ইসি গঠন করতে পারবেন কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, খসড়া অনুমোদনের পর কিছু প্রক্রিয়া আছে। মন্ত্রণালয়ে কিছু সময় লাগবে। তারপর সংসদে গেলে সেখানেও কয়েকদিন লাগবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে যাবে। তারপরও যদি এর আগেই হয়, তো হয়ে যাবে।

এদিকে, ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির কাঠামোও ইসি গঠন সংক্রান্ত খসড়া এই আইনে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়ছে। প্রধান বিচারপতি এই সার্চ কমিটির জন্য আপিল বিভাগের এক জন ও হাইকোর্ট বিভাগের এক জন বিচারপতিকে মনোনয়ন দেবেন। তাদের সঙ্গে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি), সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতি মনোনীত দু’জন বিশিষ্ট নাগরিক এই কমিটির সদস্য হবেন। তাদের মধ্যে আপিল বিভাগের বিচারপতি হবেন সার্চ কমিটির প্রধান।

এই সার্চ কমিটি নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য যোগ্য ব্যক্তিদের নামের প্রস্তাব করবে রাষ্ট্রপতির কাছে। সেই তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছরের জন্য নতুন নিবাচন কমিশন গঠন করবেন। -সারাবাংলা