চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সিলেটে সংহতি ও সংস্কৃতি সমাবেশ

চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সিলেটে সংহতি ও সংস্কৃতি সমাবেশ

চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির আন্দোলন নিয়ে যখন বাগান কর্তৃপক্ষ নির্বিকার, এই দুই পক্ষের মধ‍্যে 'তৃতীয় পক্ষ' হয়ে শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে নাগরিক আন্দোলন, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষজন। তাঁরা তৃতীয় পক্ষ ব‍্যানারে আন্দোলনরত চা-শ্রমিকদের সমাবেশে একাত্ম হয়ে মজুরি বৃদ্ধির দাবি দ্রুত মেনে নেওয়ার আহবান জনান। সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে তৃতীয় পক্ষ ব‍্যানারে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সংহতি ও সাংস্কৃতিক সমাবেশ হয়।

সাবেক ছত্রনেতা শহীদুজ্জামান পাপ্লু'র সঞ্চালনায় ও সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী'র সভাপতিত্বে সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম কিম 'তৃতীয় পক্ষের' হয়ে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।

সূচনা বক্তব্যে আব্দুল করিম কিম বলেন, ১৯ দিন থেকে শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরীর দাবিতে আন্দোলনে। এখানে মালিক ও শ্রমিক, শোষক ও শোষিত, বিত্ত ও দারিদ্র্যের লড়াইয়ে সরকার তৃতীয় পক্ষ হয়ে সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারতো। কিন্তু তা না করে কালক্ষেপন করে আন্দোলনকে রাজপথ-রেলপথ অবরোধে নিয়ে যাওয়া হয়। নিরন্ন শ্রমিকদের পিঠ আজ় দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই এই দুই পক্ষের মাঝে তৃতীয় পক্ষ হয়েই আমরা নাক গলাতে এসেছি। আমরা খোলা চোখে যা দেখেছি তা থেকেই ধারনা করতে পারি চা-শ্রমিকদের জীবনমান। মালিক পক্ষ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিতসার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শ্রমিকদের কোন স্বর্গে বিরাজমান রেখেছেন তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ নেই। বিবেকবান মানুষমাত্র রুগ্ন শরীর, বিবর্ণ বসতি ও অন্ধকার ভবিষ্যত দেখে যা বোঝার তা বুঝে গেছে। তাই তাঁদের স্বপক্ষে আওয়াজ উঠছে দিকে দিকে।

তিনি আরো বলেন, চা শিল্পে যদি কোন মধু না থেকে থাকে তাহলে কোন যুক্তিতে দেশের পুঁজিপতিরা বাগানের ইজারা ক্রয় করেন? শত শত কোটি টাকায় বাগানের ইজারাদার বদল হয় কিন্তু শ্রমিকের মজুরী এক ডলারে আটকে থাকে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক শ্রম সচিব মাহফুজুল হক বলেন, তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল চা শ্রমিকদের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকায় কাছে থেকে দেখেছি শ্রমিকদের জীবনমান। এই মজুরী কোন ভাবেই জীবনমান বদলাতে পারে না।

সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক), সিলেট সভাপতি সমিক জাহান চৌধুরী বলেন, চা-শ্রমিকদের সাথে একজন উন্নয়নকর্মী হিসাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, এই জনগোষ্ঠিকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

কানাডার লরেন্সন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডঃ সাদিকুল ইসলাম বলেন, একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরী মাত্র এক ডলার! যা অবিশ্বাস্য।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ নাজিয়া চৌধুরী বলেন, 'সরকারি তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। চা-শ্রমিকদের বার্ষিক আয় মাত্র ৪৩ হাজার ২০০ টাকা।তাই চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির প্রতি সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে তাদের ন্যায্য ও মানবিক ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবি সুদীপ্ত অর্জুন বলেন, বর্তমান বাজারে একজন শ্রমিকের পরিবারসহ বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক মাত্র ১২০ টাকা মজুরি যে কোনোভাবেই যথেষ্ট না, তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনকি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারণ করা মজুরির হারও চা শ্রমিকদের দাবি করা ৩০০ টাকার চেয়ে বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অক্টোবর ২০২০-এর সার্কুলার অনুসারে দেশের জেলা-উপজেলায় দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা একজন দক্ষ শ্রমিকের মজুরি হবে সর্বনিম্ন ৫৫০ টাকা। অথচ চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা থাকবে না, ১৪৫ টাকা হবে—তা নিয়ে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দরকষাকষি করছে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর এবং চা বাগানের মালিক পক্ষ। চা শ্রমিকরা ৩০০ টাকার বদলে দৈনিক মজুরি সরকার ঘোষিত রেটের সমপরিমাণ ৫৫০ টাকা নির্ধারণের দাবি তুললেও তা অন্যায্য হতো না।

সভাপতির বক্তব্যে উজ্জ্বল মেহদী বলেন, একটি শ্রমিক আন্দোলনেল ব্যাপ্তি যখন রাজপথ রেলপথ অবরোধে গড়ায় তখন সে আন্দোলন শুধু দুই পক্ষের থাকে না। আপনাকেও পক্ষ বেছে নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হয়। সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক-মজুর সহজে আন্দোলনে নামে না। পিঠ দেওয়ালে ঠেকলেই প্রান্তিক মানুষেরা বিশেষ করে নারী-শিশুরা দিনের পর দিন আন্দোলন করে। বিগত ১৯ দিন ধরে সিলেটের চা বাগান সমুহে শ্রমিকেরা কর্ম বিরতির মাধ্যমে নিজেদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন শুরু করেছে। বাগান মালিকদের উপেক্ষা ও আলোচনার টেবিলের টালবাহানা সেই আন্দোলনকে রাজপথে নিয়ে এসেছে। জাতীয় মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধের মধ্য দিয়ে আন্দোলন এখন নো রিটার্ণে পৌছেছে। এ অবস্থায় চা শ্রমিকদের আন্দোলন শুধুমাত্র চা শ্রমিকের আন্দোলন নয়। এ আন্দোলন মেহনতি মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়ার আন্দোলন। ইতোমধ্যে আন্দোলনের যৌক্তিকতা সর্বমহলে আলোড়ন তুলেছে। তাই তৃতীয় পক্ষ হয়ে এই আন্দোলনে আমরা শ্রমিকদের প্রতি সংহতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।

মালনীছড়া চা বাগানের মন্ডপে হাজার শ্রমিকের জমায়েতে মজুরি বৃদ্ধির দাবির পক্ষে চলে গান ও স্লোগান। এতে অংশ নেন উদীচী ও নগরনাট সাংস্কৃতিক সংগঠনের শিল্পীরা।

চা-শ্রমিকদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে আরো বক্তব্য রাখেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মোঃ আশরাফুল করিম, তথ্যচিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক নিরঞ্জন দে যাদু, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম সিলেট জেলার সভাপতি গৌরাঙ্গ পাত্র, সম্মিলিত নাট্য পরিষদ সিলেটের সহ-সভাপতি উজ্জ্বল দাশ, আমরা হাওরবাসী সুনামগঞ্জের প্রধান সমন্বয়ক রুহুল আমিন, গণজাগরণ মঞ্চ সিলেটের সমন্বয়ক দেবাশীষ দেবু, ভূমিসন্তান বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ আশরাফুল কবির, খাসি ষ্টুডেন্ট ইউনিয়ন-এর সভাপতি আলি জ্যাক, দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা-এর  সংগঠক এডভোকেট দেবব্রত চৌধুরী লিটন, উষা পরিচালক সাদিয়া নিঘাত প্রমুখ। আন্দোলনরত শ্রমিকদের পক্ষে মালনীছড়া বাগান পঞ্চায়েতের নেতা সুবল বাড়াই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।