যাদের পরিচয় 'কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা'

যাদের পরিচয় 'কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা'
ছবি- জাগো সিলেট

কামরুল ইসলাম মাহি || বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার টংরাখালি গ্রামের নুরুল ইসলাম। লেখাপড়া তেমন নেই। আর্থিক অসচ্ছলতায় টানাপোড়ন থাকে সংসারে। পরিবার নিয়ে একটু সুখের আসায় খুঁজতে থাকেন কাজ, যেখানে আয় ভালো। পরিচিত একজন তাকে জানান সিলেটে অনেক ভালো কাজ পাওয়া যায়। বেতনও ভালো। পরিবার রেখে কোন ভাবনাচিন্তা ছাড়াই ছুটে আসেন সিলেটে। কিন্তু বিধিবাম! কাওকে চেনেন না, জানেন না, কোথায় যাবেন। বাস স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে আশ্রয় নেন কীনব্রিজের নিচে। রাত পার হয় দুশ্চিন্তায়। সকাল এক রিকশাচালক জানালেন, কীনব্রিজে রিকশা ঠেললে ৫ টাকা পাওয়া যায়। উপায় না পেয়ে শুরু করেন এই কাজ।

আলাপকালে নুরুল জানালেন প্রায় ১৫ ধরে এই ব্রিজে রিকশা ঠেলার কাজ করছেন তিনি। বলেন, প্রথম যখন আসি তখন রিকশা ঠেলে উপরে তুলে দিলে ৫ টাকা পাওয়া যেত এখন ১০ টাকা।প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। কষ্টদায়ক হলেও কাজটি স্বাধীন। না করলেও কাউকে জবাবদিহীতা করতে হয় না।

শুধু নুরুলই নন এরকম প্রায় এক হাজার  শ্রমিক রয়েছেন এই ব্রিজে। তারা ‘কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ হিসেবেই পরিচিত। পরিচয় ‘ঠেলাওয়ালা’ হিসেবে হলেও তারা কেউই ঠেলাগাড়ি চালান না। ব্রিজ দিয়ে চলাচলকারী রিকশা ও ঠেলাগাড়ির পেছনে ধাক্কা দিয়ে ব্রিজে তুলতে সাহায্য করেন তারা। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের এই ‘ঠেলা’ দিয়ে দিয়েই চলে নিজের জীবনের চাকাও।

মূলত সিলেট নগরকে দু’ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে সুরমা নদী। আর এই বিভক্তিকে কিনব্রিজ তৈরি করেছে যোগাযোগের সেতুবন্ধন। এটি সিলেটের প্রবেশদ্বার হিসেবেও পরিচিত। ১৯৩৬ সালে নির্মিত এই সেতুটি আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কীন’র নামে নামকরণ করা হয়। স্টিলের তৈরী ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৩৯৫ মিটার।

কীন ব্রিজে চলাচল করা অনেকটা পাহাড় চড়ার মতো। উঁচু সেতুটিতে খাড়া পথ দিয়ে উঠে ঢালু পথ দিয়ে নামতে হয়। এতে উঁচু সেতুটিতে রিকশা ও ঠেলাগাড়িকে টেনে তুলতে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত লোকবলের। এই প্রয়োজনীয়তা থেকেই ‘কীনব্রিজের ঠেলাওয়ালা’ পেশা হয়ে গেছে অনেকের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রিজের দুইপাশেই অনেকটা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন শ্রমিকরা। রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চালকরাই তাদের ডেকে নেন সহযোগীতার জন্য। আবার অনেক সময় ঠেলাওয়ালারাই রিকশা ও ঠেলাগাড়ি দেখলে হাঁক দেন, ‘এই, ঠেলা লাগবো, ঠেলা...’। ১০ বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন এই পেশায়।

আলাপকালে শ্রমিকরা জানান, দিনভর পরিশ্রম শেষে কীনব্রিজের গোড়া, সিলেট রেলস্টেশন আবার কেউ কেউ বিভিন্ন কলোনিতে রাত কাটান। ব্রিজ এলাকায় খাবারের দোকানে খাওয়া দাওয়া করেন তারা।

তারা জানান, ঠেলা দিয়ে ব্রিজ পার করার জন্য তারা প্রতিটি রিকশার কাছ থেকে নেন ১০ টাকা করে আর ঠেলাগাড়ির কাছ থেকে নেন ২০ টাকা করে। এই টাকা রিকশাযাত্রী আর ঠেলাগাড়ির পণ্যের মালিকরা দেন।

মিঠুন মিয়া নামের এক যুবক বলেন, রিকশা ঠেলানি খুব কষ্টের, রিকশা ঠেলানির সময় পেটের ক্ষুধায়ও ঠেলা দেয়। সারাদিন ঠেলা দিয়ে রাত হলেই শরীরে হাড়ে হাড়ে ব্যথা করে। প্রতিদিন তার ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা আয় হয়। এ আয় দিয়েই তার সংসার চলে।

মনির মিয়া এক কিশোর শ্রমিক জানান, তার বাড়ি ময়মনসিংহ। পাঁচ বছর ধরে কিন ব্রিজে রিকশা ঠেলছেন। দরগাহ মহল্লা এলাকায় থাকেন। মনির বলেন, ‘রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়া রিকশা ঠেলি। শরীরের ঘাম পায়ে ফেইলা ইনকাম করি। কষ্ট আছে, তৃপ্তিও আছে।’

আলম মিয়া নামেন আরেকজন জানান, সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ কাজ করি। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি রিকশা ঠেলতে পারি। দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ টাকাতেই চলে সংসার। খুব কষ্টে চলে জীবন।

দিলোয়ার নামের অপরএক শ্রমিক বলেন, পুরোনো রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় অসুস্থ মা, স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকি। ১০ বছর ধরে কিনব্রিজে রিকশা ঠেলছি। বড় মেয়ের বিয়ের বয়স হয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে কাপড়ের দোকানে চাকরি করে। বয়সের কারণে আগের মতো রিকশা ঠেলতে পরিনা। প্রতিদিন গড়ে তাঁর ২৫০ টাকা আয় হয়। আমার ও ছেলের আয়ে সংসার চলছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে।