সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনের ভয়ঙ্কর ঘটনা জানালেন সাংবাদিক সালমান

সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনের ভয়ঙ্কর ঘটনা জানালেন সাংবাদিক সালমান

সালমান ফরিদ একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও প্রভাষক। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) এ স্থায়ী সদস্য কাজ করেছেন নামকরা একটি জাতীয় দৈনিকের স্বাস্থ্য বিটে।

মফস্বল সম্পাদক হিসেবেও পদোন্নতি পেয়ে কাজ করেছেন একই পত্রিকায়। অসংখ্য গুণী মানুষ তার সখ্য। সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও তার প্রতিবেদনে সহায়ক।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত নিজের দায়িত্বপালনের সময় যে কজন সাংবাদিককে গুরুত্ব দিতেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সালমান ফরিদ। ঢাকায় নিজ দায়িত্ব ছেড়ে পরিবারের প্রয়োজনের খাতিরে সালমান চলে আসেন নিজ এলাকা সিলেটে। তিনি বর্তমানে সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সদস্য। দৈনিক শুভ প্রতিদিনের প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

সম্প্রতি সাংবাদিক সালমান হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ভারতে গিয়ে এনজিওগ্রাম করালে তার হার্টে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। দেশে ফিরে সিলেট নগরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। খ্যাতনামা চিকিৎসক প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিনের তত্ত্বাবধানে থেকে হার্টে রিং বসান তিনি। অস্ত্রোপচারও সফল হয় তার। কিন্তু পরবর্তীতে এ সংবাদকর্মীর সঙ্গে হাসপাতালের অন্য চিকিৎসক ও সেবায়েতরা যে দুর্ব্যবহার করেন তা নিছক নিন্দনীয় এবং ক্ষমার অযোগ্য!

হাসপাতালের কর্তব্যরত দুই চিকিৎসকের খামখেয়ালীতে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন সাংবাদিক সালমান। শুধু সালমান নন, তার মতো বহু রোগীর অভিযোগ রয়েছে সিলেট নগরের ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের বিরুদ্ধে। সেবা নিয়ে তো আছেই, কর্মরত নার্সদের বিরুদ্ধেও অশালীন আচরণের অভিযোগ আছে শত শত।

নিজের সঙ্গে ঘরে যাওয়া ভয়ঙ্কর মুহূর্তের কথা সাংবাদিক সালমান তুলে ধরেন তার ফেসবুকের পাতায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটিতে তিনি যা লিখেছেন, বাংলানিউজ পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-

‘১৪ সেপ্টেম্বর বিকেলে সিলেট হার্ট ফাউন্ডেশনে আমার হার্টে ৩টি রিং বসানো হয়। আলহামদুলিল্লাহ, প্রিয় চিকিৎসক প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিন বেশ পরিশ্রম করে রিং বসানোর কাজটি সম্পন্ন করেন। তখনও কোনো সমস্যা হয়নি। আমাকে সিসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭ থেকে ৮টার দিকে দুজন লোক এসে বলেন, আপনার এনজিওপ্লাস্টির সময় উরুতে বসানো দুটি পাইপ/বড় ক্যানোলা রিমুভ করবো। ভয় পাবেন না, লোকাল এনেস্থিসিয়া দেওয়া হবে। বলেই তারা ডান পায়ের উরুর ব্যান্ডেজ না ভিজিয়ে খুব জোরে খুলে ইনজেকশন পুশ করলেন। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে পাইপ/বড় দুটো ক্যানোলা একটানে খুলে ফেললেন। সাথে সাথে আমার শরীর ঝিমিয়ে যেতে শুরু করলো। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। অক্সিজেন, হার্টের পালস রেট ৩/৪ সেকেন্ডের মধ্যে ৩০-২৫ এ নেমে আসে। আমার চোখ উল্টে গেল, ঝাপসা দেখছি। একজন আমার বুকে কিল-ঘুষির মত করে চাপ দিচ্ছিলেন এবং আমাকে বারবার বলছিলেন কাশি দিতে। পাগলের মতো ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে বারবার বলছেন, কাশি দেন, কাশি দেন, জোরে জোরে কাশি দেন। আমিও জীবনের শেষ ও সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কাশি দিচ্ছিলাম। সাথে কালিমা পড়ছিলাম আর কাশি দিচ্ছিলাম অনবরত এবং ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এসেছিলাম। এ সময় একজন খুব দ্রুত একটি ইনজেকশন এনে আমার বাম হাতের ক্যানোলা দিয়ে পুশ করলেন।

সিসিইউ, পিসিসিইউ, ওটিসহ হাসপাতালের সব ডাক্তার, নার্স এসে জড়ো হয়েছেন আমার চারপাশে। তাদের চোখ ভয়ার্ত। চিৎকার চেঁচামেচি শুনছিলাম। সবশেষ মনিটরে চোখ গিয়েছিল। আবছা মনে আছে, একটি দেখেছি শূন্যের কোটায় আরও কোনো একটি ১৫/২০ এ ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, এ-ই বোধহয় আমি শেষ। পৃথিবীতে নিয়ে আসা নিঃশ্বাসের শেষ নিঃশ্বাসগুলো ফেলছি। হাত তুলতে গিয়েও শক্তি পেলাম না। নিস্তেজ। কলিজার টুকরো মেয়ে সোহার মুখটা ভেসে উঠলো। কালিমা পড়ছি আর কাশি দিচ্ছি প্রাণ শপে। ভাবছিলাম, হয়ত কাশি দিলে হার্টের সচলতা ফিরে আসবে। হয়ত আল্লাহ নিঃশ্বাস ফিরিয়ে দেবেন তার দয়ার আনুকূল্যে। একসময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। এরপরে আমার আর কিছু মনে নেই।

যখন জ্ঞান ফিরলো, রাত তখন সাড়ে ১১টার দিকে হবে। দেখলাম, শিয়রে প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিন। ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় কথা বলতে পারলাম না। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। হাতে স্নেহ এবং ভালবাসা ছিল। পরে শুনেছি, আমি কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের শেষ পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম! আমার হার্ট ফেইলিওরের কাছাকাছি ছিল।

কিন্তু কেন? কার দোষে? কোন কারণে? জ্ঞান যখন মোটামুটি ফিরল, সিসিইউর চিকিৎসকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমনটি অনেকের হয়। ওই পাইপ/বড় ক্যানোলা খুলতে গেলে প্রেশার কমে যায়। তাই এমন পরিস্থিতি হয়। এটা তেমন কিছু না!

আমি সন্তুষ্ট হলাম না। আসলেই কি তাই? আসলেই কি তেমন কিছু না? নাকি ওই দুই লোকের খামখেয়ালিপনার বলি হতে যাচ্ছিলাম আমি? তারা কি ভুলভাবে রিমুভ করছিলেন? তারা কি ভুলভাবে লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়েছেন? নাকি এনেস্থিসিয়া দেওয়ার পর বড্ড তাড়াহুড়ো করছিলেন? কারণ, এনেস্থিসিয়া দেওয়ার পরও আমি খুব ব্যথা পেয়েছিলাম। এমনকি প্লাস্টার রিমুভ করবার সময় উরুর পুরো জায়গাটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল! এটি কি তাদের অদক্ষতা? রোগীর প্রতি চরম অমনোযোগিতা? আমি ‘উহ!’ বলে উঠলে তারা বলেছিলেন, লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়েছেন ব্যথা লাগবে না!

তখন তারা আমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে খোশগল্পে বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এত বড় একটি সেন্সেটিভ কাজে তারা এতটাই বিন্দাস ছিলেন, তার মানে আমার জীবনের মূল্য তাদের কাছে একেবারেই ছিল না।

সালমান ফরিদ নামে কেউ একজন তাদের অমন খামখেয়ালির কারণে ওদিন মারা গেলে আসলেই তাদের কিছু যেতে-আসতো না। তাদের হয়ে হাসপাতালের সুনাম রক্ষার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ মেডিকেলের কোনো একটা অজুহাত দিয়ে পার পাইয়ে দিতেন। কিন্তু আমাকে হারাতো আমার পরিবার। মা-বাবা তাদের সন্তান হারাতো। আমার সন্তান তার বাবা হারাতো। আমার স্ত্রী তার জীবনসঙ্গী হারাতো। আমার ভাই-বোন তাদের বড় ভাইকে হারাতো। কিন্তু এদের কিছুই হতো না। কিছুই হারাতো না। অনুশোচনাও হতো না। হয়ত একটা বিবৃতি আসতো হাসপাতাল থেকে ‘সিনিয়র সাংবাদিক, কবি-লেখক ও কলেজ শিক্ষক সালমান ফরিদের মৃত্যু আসলে ইচ্ছাকৃত নয়, এটি একটি দুর্ঘটনা মাত্র! আমরা এ ঘটনার জন্য দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী! আমরা তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি!’

এই ঘটনার পর আমি কি কারও কাছে নালিশ দিতে পারি? কারও কাছে বিচার চাইতে পারি? চারদিক অন্ধকার। ধোঁয়াশা। কোথাও শোনার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই। সবাই ফাঁদ পেতে বসে আছে শুধু শিকার ধরবে বলে! আকাশের মালিক ছাড়া আমাদের এখন কেউ নেই। তাই চুপচাপ! তবে লাখো শুকরিয়া সেই মহান রাব্বে কারিমের দরবারে। যিনি সব বিপদ থেকে তার মায়ার ছায়ায় রেখে উদ্ধার করে এনে আমাকে আপন নীড়ে পৌঁছে দিয়েছেন। তা না হলে আজ আমি কবরবাসী হয়ে থাকতাম!

এ ব্যাপারে তার সাথে কথা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, মানুষের সচেতনতার জন্যই মূলত আমার এ পোস্ট দেওয়া। তারা যাতে কারও সঙ্গে খামখেয়ালিপনা না করে, জীবন নিয়ে ছিনিমিনি না করে সে লক্ষ্যে আমি পোস্টটি করেছি। এ ছাড়া বিশেষ কিছু নয়।

তবে সালমানের স্ত্রী উম্মে সুমাইয়া তানজিব নীলা বলেন, যখন আমার স্বামীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, আমি নামাজের যাই। তখন হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মীরা আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। নামাজের কক্ষ থেকে আমাকে বের করে দেয়।

এসব ব্যাপারে তারা অভিযোগ করবেন কিনা জানতে চাইলে এমন কোনো ধারণা দেননি। তবে সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতা চেয়েছেন, যাতে করে আর কেউ হয়রানির শিকার না হয়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ট্রেজারার আবু তালেব মুরাদকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি দেখছি। আমরা প্রধান নির্বাহীর (সিইও) সঙ্গে কথা বলেছি। এ ছাড়া প্রফেসর ডা. খালেদ মহসিনের সঙ্গেও কথা বলেছি। দুজনকেই সাংবাদিক সালমানের ফেসবুক পোস্টের কপি দেওয়া হয়েছে। খামখেয়ালিপনার ব্যাপারে যে দুজন চিকিৎসক ও দুর্ব্যবহারের জন্য যে নার্সদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।