এই অবরোধে মানুষের আগ্রহ নেই, আছে বিরক্তি
বিশেষ প্রতিনিধি
রোববার থেকে শুরু হয়েছে বিএনপির ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ। গত ২৮শে অক্টোবর সমাবেশ শেষে, ৩১শে অক্টোবর থেকে ২রা নভেম্বর ৩ দিনের অবরোধ শেষে এই অবোরোধের ডাক দেয়। যদিও ২০১৮ সালে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার ডাকা লাগাতার অবরোধ এখনো চলছে। কারণ তিনি সেই অবরোধ শেষ করার ঘোষণা দেননি। পল্টন মোড়ের পানের দোকানদার ইস্রাফিল মোল্লা জানান, ৫ বছর আগের সেই অবরোধ বিএনপি দাপ্তরিক ভাবে না তুলে নিলেও তার মত ছোট ব্যবসায়ীসহ বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ জীবনের তাগিদে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক করে নিয়েছিলেন। এবারো বিএনপির কর্মসূচির সেই অবস্থা হবে বলে আভাস দেন ইস্রাফিল।
কবে থেকে মানুষ আস্থা হারালো অবরোধের মত কর্মসূচীতে? এই প্রশ্নের জবাবে, সাবেক ছাত্রলীগ এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা হাসান তারেক জানান, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে সবচেয়ে বড় বিবর্তন দেখা যায় ২০১৪ সালের বিএনপির ডাকা টানা অবরোধ কর্মসূচী থেকে। সেই প্রথম অবরোধের নামে শুরু হয় আগুন সন্ত্রাস। পেট্রোল বোমা, অকটেন দিয়ে চলন্ত যাত্রীবাহী বাস পুড়িয়ে দেয়া। অবরোধ না মানলে জনসাধারণের উপর হামলা, জানমালের ক্ষতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর হামলা এবং সর্বোপরি পুলিশের উপরে হামলা করতে দেখা যায় বিএনপির কর্মী সমর্থকদের।
শুধু ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ব আর নির্বাচন উত্তর কর্মসূচীতে ২০০’শর বেশি সাধারণ মানুষ আগুনে পুড়ে মারা যায়। পুলিশ মারা যায় প্রায় ৭০ জনের মতো। আবার সেই অবরোধ শুরু হলো। এরইমধ্যে চোরাগোপ্তা হামলাও শুরু হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে এসে সেই একই ধারা বজায় রেখেছে তারা। কোনো মিছিল নেই, কোথাও রাস্তায় জড়ো হয়ে বসে থাকা নেই। কোথাও জনসম্পৃক্ততা নেই, কোন পোস্টার নেই, কোন লিফলেট নেই, শুধু হুটহাট করে গোপনে কয়েকজন বিএনপির দলীয় কর্মী এসে অতর্কিত হামলা করে আগুন দিয়ে আবার পালিয়ে যায়।
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী গত ২৯, ৩০ ও ৩১ শে অক্টোবরের অবরোধে, গাড়ি পোড়ানো হয়েছে ৩১ টি। মারা গেছেন ২ জন পুলিশ অফিসার আর ৩ জন পথচারী। বিভিন্ন জায়গার চোরাগোপ্তা হামলা এবং আগুন ধরাতে গিয়ে জনগণের রোষানলে পড়ে আটক হয়েছে একাধিক বিএনপির নেতাকর্মী।
হাসান তারেক আরও জানান, ২০২৩ সালে এসেও দেখা যাচ্ছ, জনসম্পৃক্ততাহীন বিএনপি শুধু একটিই প্রতিবাদের ভাষা বোঝে- সেটা হচ্ছে সন্ত্রাস। একদিকে তারা গণমানুষের অধিকারের সাথে সম্পৃক্ত এমন কোন দাবি সৃষ্টি করতে পারছে না, যাতে জনগন স্বেচ্ছায় সম্পৃক্ত হবে বা অংশগ্রহন করবে। দ্বিতীয়ত, তারা চেষ্টা করছে সরকার ও প্রশাসনকে ভয় দেখাতে ও জনগণের ক্ষতি করে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে। এই দুই কারনেই তারা বেছে নিয়েছে আগুন সন্ত্রাস বা সহিংস সন্ত্রাসের মতো কর্মকাণ্ড। চোরাগোপ্তা হামলা করে, পুলিশ বা জনসাধারণকে হত্যা করে তারা চাইছে জান মালের উপর হুমকি সৃষ্টি করতে।
ইদানিং কালের অবরেধ নিয়ে, একজন বামপন্থী সাবেক ছাত্র নেতা বললেন, সাধারণ মানুষের দাবী-দাওয়া পূরণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার ছিল অবরোধ। বিএনপি জামায়াতের অপব্যবহারের কারণে এই কর্মসূচিটি খেলো হয়ে গেছে। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে ৬৬, ৬৯, ৭০ সালে তথা মুক্তিযুদ্ধের আগে অবরোধ করে পাকিস্থানি সামরিক শাসকের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালি। ৭১’এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষনার পর বাঙালি সর্বাত্মক অবরোধের মাধ্যমে, কার্যত বাংলাদেশ অচল করে দিয়ে স্বাধীনতার ভীত রচনা করে। বাংলার প্রতিটি মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল সেই কর্মসূচির প্রতি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দেখা যায় মানুষের অধিকার আদায়ে কার্যকর হরতাল ও অবরোধের মত কর্মসূচি। ৯০ এর দশকের পত্রপত্রিকায় দেখা যায়, অবরোধ হয়েছে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের দাবিতে। তখন অবরোধের দিনে রিকশা ছাড়া কোন যানবাহন চলতো না ঢাকা শহরে। '৯৬ সালেও আওয়ামী লীগের ডাকা অবরোধে কার্যত অচল হয়ে যেতো ঢাকা শহর। ২০০৪ সালে সেসময়ের বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড দিয়ে হত্যার চেষ্টা এবং ২২জন আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে যে অবরোধ করেছিল আওয়ামী লীগ তাতেও মানুষ সর্বাত্মকভাবে অংশ নিয়েছিল। সেই সহিংসতার প্রতিবাদে সেদিন কোন সন্ত্রাস হয়নি। রাজনৈতিকভাবেই প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছিল হাজার হাজার মানুষ।