টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দিনবদলের গান

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দিনবদলের গান

হাহাকারগুলি মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়। উড়ছে এখন স্বপ্নের রেণু। বছরের পর বছর ধরে চলা হতাশার আঁধার ফুঁড়ে উঁকি দিচ্ছে আশার সূর্য। টি-টোয়েন্টি সংস্করণে দেশের ক্রিকেটে বইছে সুবাতাস। সেই উষ্ণতায় মিশে আছে রোমাঞ্চ। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে তৃপ্তির সুর, অবশেষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ভাষা পড়তে পারছে বাংলাদেশ দল!

সেটি পারার প্রমাণ যেমন ফলাফলে আছে, তেমনি আছে খেলার ধরনে। দর্শনে। মানসিকতায়। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকেই ইঙ্গিতটা মিলছিল। এরপর গত কয়েক মাসে ইংল্যান্ড সিরিজ, আয়ারল্যান্ড সিরিজ হয়ে এবার আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টির পারফরম্যান্স, সবকিছুতেই ফুটে উঠেছে নতুন দিনের প্রতিচ্ছবি। বদলে গেছে টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশ।

এই সংস্করণে বাংলাদেশের ভালো কিছু পারফরম্যান্স আছে আগেও। তবে তা ছিল অধারাবাহিক। ‘বাংলাদেশি ব্র্যান্ড’ বলে একটি ঘরানার জোয়ার তোলার চেষ্টাও হয়েছিল একসময়। তবে সেখানেও ভাটা পড়েছে দ্রুতই। টুকটাক কোনো ম্যাচে বা সিরিজে দারুণ কিছু মিলেছে কখনও কখনও। কিন্তু দল হিসেবে নিজেদের মেলে ধরা, সত্যিকার অর্থেই আলাদা ঘরানা তৈরি করার ব্যাপারটি হয়ে উঠছিল না। অবশেষে সেই দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটে চলে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে।

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করবে বাংলাদেশ, কজন ভাবতে পেরেছিলেন! এই দল তা করে দেখিয়েছে গত মার্চে। এরপর সিরিজ জয় ধরা দিয়েছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। আফগানিস্তানের যে বোলিং আক্রমণ, এই কন্ডিশনে চ্যালেঞ্জটা হয়তো ইংল্যান্ডের চেয়েও বেশি। কিন্তু এই সিরিজেও প্রথম ম্যাচে বেশ কিছু চাপের মুহূর্ত জয় করে শেষ পর্যন্ত ম্যাচও নিজেদের করে নিতে পেরেছে বাংলাদেশ।

তবে ফলাফল তো স্রেফ একটি ব্যাপার। এই বাংলাদেশকে আলাদা করে চোখে পড়ছে তাদের ক্রিকেটের ধরনেই। এই দলটার ভেতর যেন জমা আছে বারুদ। এই দলের ব্যাটিং-বোলিং আর মানসিকতায়, শরীরী ভাষায় আছে ভয়ডরহীন ও আগ্রাসী ক্রিকেটের স্পর্ধা। ফলাফল পক্ষে আসায় আত্মবিশ্বাসও এখন জমাট। সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে টি-টোয়েন্টির বাংলাদেশ।

রোববার দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেও যদি আফগানিস্তানকে হারানো যায়, তাহলে এই বছর সপ্তম জয় পাবে বাংলাদেশ। এক বছরে এর চেয়ে বেশি টি-টোয়েন্টি জিতেছে বাংলাদেশ একবারই, ২০২১ সালে। তবে সেই বছর ১১ জয়ের পাশে হার ছিল ১৬ ম্যাচে। এবার সেখানে সাত জয় হয়ে যাবে স্রেফ ৮ ম্যাচেই! এমনকি ২০১৬ সালে ৭টি জয় ধরা দিলেও হার ছিল ৮ ম্যাচে।

সেদিক থেকে রোববার জিততে পারলে এই বছরকে টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের সেরা বছরও বলা যেতে পারে।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দিনবদলের গান
দেশের ক্রিকেটের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব, কোচ ও বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিমের চোখেও এই পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ছে স্পষ্ট হয়ে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ক্রিকেটে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসা এই ক্রিকেট বিশ্লেষক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বললেন, এই পরিবর্তনে তিনি বড় ভূমিকা দেখেন সবশেষ বিপিএলের।

“এতদিন আমাদের টি-টোয়েন্টি ছিল ওয়ানডে ক্রিকেটেরই একটি এক্সটেনশন। টি-টোয়েন্টির যে দর্শন, এটাই এতদিন আমরা ধরতে পারিনি। আমার ধারণা, গত বিপিএল থেকে বড় পরিবর্তন এসেছে। গত বিপিএলে উইকেট খুব ভালো ছিল। আর আমাদের ক্রিকেটাররা প্রায় সব দলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ পেয়েছে। সাধারণত ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোতে ওপরের দিকে ব্যাট করে বিদেশিরা, মূল বোলারও থাকে বিদেশিই। তবে এবার ব্যতিক্রম ছিল।”

“গত বিপিএলে রনি তালুকদার, শান্ত, শামীম, হৃদয়, ওরা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পেয়ে দারুণ খেলেছে। বোলারও কয়েকজন খুব ভালো করেছে। তারা এখন জাতীয় দলেও টি-টোয়েন্টিতে পারফর্ম করছে। বিপিএলে বড় রান হয়েছে, বড় রান তাড়া হয়েছে। সেটির পথ ধরে এবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও (৫০ ওভারের সংস্করণ) খেলার ধরনে পরিবর্তন দেখেছি এবার আমরা। ৭০-৮০ বলে সেঞ্চুরি দেখা যাচ্ছে এখন। এই পরিবর্তন গত বিপিএল থেকেই এসেছে।”

দলের মনস্তত্বে পরিবর্তনের পেছনে নাজমুল আবেদীন বড় প্রভাব দেখছেন নেতৃত্বের। স্বাধীনভাবে খেলা, আগ্রাসী মানসিকতা নিয়ে মাঠে নামা, এসব নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে বহুবার। কিন্তু দলের ভেতর তা শক্ত করে বাসা বাঁধতে পারেনি। কিন্তু নাজমুল আবেদীনের মতে, এখন দলের ভেতর সেই বিশ্বাসটুকু গেঁথে দিয়েছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ও বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট দাপিয়ে বেড়ানো সাকিব আল হাসান।

“টি-টোয়েন্টিতে ফ্রিডম থাকা, সাহসিকতা নিয়ে খেলা, এসব খুব জরুরি। দলে এই বিশ্বাসগুলি দেওয়ার জন্য সাকিব খুব উপযোগী একজন। সে নিজে খুব ভালো করে বোঝে এসব ব্যাপার। ফ্রিডম মানে কিন্তু এটা নয় যে ইচ্ছেমতো খেলতে দেওয়া, এরপর না পারলে তাকে প্রশ্ন করা। ফ্রিডমটা কী, সাকিব সেটা জানে এবং সবাইকে বোঝায়। এজন্যই সবাই দায়িত্ব নিয়ে খেলে। জবাবদিহিতার ব্যাপারও আছে, সবাই নিজের কাছে জবাবদিহি করে। প্রস্তুতিতেও সেভাবেই নিজেকে তৈরি করে। সব মিলিয়েই এটা হয়।”

“ফ্রিডম থাকলে ও বুঝতে পারলে ক্রিকেটাররা অনেক নিশ্চিন্তে খেলতে পারে। আগ্রাসী সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। অনেকে মনে করতে পারে যে আগ্রাসী খেলব, কিন্তু মনের কোণে রক্ষণাত্মক ভাবনা রয়েই গেছে, তাহলে কিন্তু হবে না। যখন মনে ও শরীরে পুরোপুরি আগ্রাসী থাকা যায়, তখনই তা কাজে লাগে। যা এখন হচ্ছে। সবারই হচ্ছে না। তবে কয়েকজনের হচ্ছে। ওদেরকে দেখে বাকিরাও খেলার ধরন বদলাবে, আমি নিশ্চিত।”

আফগানিস্তানের বিপক্ষে এবার প্রথম টি-টোয়েন্টিতে শেষ ওভারে প্রায় পা হড়কে যাচ্ছিল দলের। তবে হঠাৎ চেপে বসা চাপকে শেষ পর্যন্ত জয় করতে পেরেছে বাংলাদেশ। যেভাবে এই জয়টি এসেছে, সামনের পথচলায় দলকে তা আরও এগিয়ে  নেবে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন।

“ফলাফল যখন আসতে থাকে, তখন বিশ্বাস আরও বাড়ে। কালকের ম্যাচে যেমন ফলাফল এদিক-সেদিক হতে পারত। ভাগ্যের ব্যাপার আছে এখানে। তবে এসব ম্যাচে যখন ফল পক্ষে আসে, তখন তা দলকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। এই জয় যেমন আমাদের দলকে ৫ থেকে ১০ শতাংশ ওপরে উঠিয়ে নেবে। সব কিছু মিলিয়েই বড় একটি পরিবর্তন এসেছে।”

নাজমুল আবেদীন আপাতত কিছুটা ঘাটতি দেখছেন এই দলের বোলিং বৈচিত্র ও কার্যকারিতার জায়গায়।

“টি-টোয়েন্টি ঘরানার কিছু ক্রিকেটার আমাদের আসছে। বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে। আরও অনেক উন্নতির সুযোগ আছে অবশ্যই। তবে কিছু উঠে আসছে। বোলিংয়ে একটু পিছিয়ে আছি এখনও। টি-টোয়েন্টির স্পেশালাইজড যে বোলিং, সেখানে কিছু ঘাটতি আছে। ওটা হয়ে গেলে আমরা আরও ভালো হয়ে উঠব। তবে সময় লাগবে। আরও দু-একজন ক্রিকেটারকে উঠে আসতে হবে।”

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের দিনবদলের গান
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা ভূমিকায় কাজ করা অভিজ্ঞ এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের মতে, আর কয়েকজন টি-টোয়েন্টি উপযোগী ক্রিকেটারকে পাওয়া গেলে দলটা আরও পোক্ত হয়ে উঠবে।

“তামিমকে যেমন (তানজিদ হাসান) দেখছি… ঘরোয়া ক্রিকেট, ইমার্জিং দলে এই ধরনের ক্রিকেট খেলছে। ভালো খেলার ব্যাপার শুধু নয়, মানসিকতার ব্যাপার। ওর ধরনই আক্রমণাত্মক। ও যদি নিরাপদ ক্রিকেট খেলে, তারপরও ১০০ বলে ১০০ করবে। এতে হয়তো আরও বেশি চোখে পড়বে লোকের। কিন্তু ওর ধরনই হলো যে, আক্রমণ করবেই। এটা খুব জরুরি। এটা কারও মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না। ও মানসিকভাবে টি-টোয়েন্টি ঘরানার ক্রিকেটার। এটা হৃদয়, শামীমের মধ্যেও আছে।”

“বিপিএল যদি এভাবেই হতে থাকে, ভালো উইকেট, ভালো লড়াই, সবকিছু যদি ন্যায্য থাকে, সবার মনোযোগ খেলায় থাকে, তাহলে অবশ্যই হবে। আরেকটি ব্যাপার হওয়া দরকার, প্রতিভা চিহ্নিত করা। কোনো না কোনোভাবে দারুণ একজন লেগ স্পিনার যদি পাওয়া যায়, সে হয়তো এখনও পর্যন্ত খেলেইনি, তাকে তৈরি করে মাঝেমধ্যে সুযোগ দিলে দেখা যেতে পারে কাজে লেগে গেল।”

এই দলের সামনে এগোনোর পথে একটি বড় চ্যালেঞ্জ অবশ্য আসবে সামনেই। আফগানিস্তান সিরিজের পর লম্বা সময় আর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি নেই। আবার আগামী ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা জানুয়ারিতে নিউ জিল্যান্ড সফরে টি-টোয়েন্টি খেলবে বাংলাদেশ। 

এখানেই ঘরোয়া ক্রিকেট ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন নাজমুল আবেদীন। ঘরোয়া ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট বাড়ানোর যে দাবি, সেটিই আবার উঠে এলো তার কণ্ঠে। 

“এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন। এজন্যই ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর খেলা হতে হবে। টুর্নামেন্ট বলতেই আমরা বিপিএল, ডিপিএল, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বুঝি। কিন্তু টুর্নামেন্ট আরও বাড়াতে হবে। চট্টগ্রামে বা খুলনায়, সিলেটে বড় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হতে পারে না?”

“সেখানে হয়তো আমাদের শীর্ষ ক্রিকেটাররা খেলবে না। কিন্তু পরের ধাপের ক্রিকেটাররা খেলবে। অনেক টাকার ব্যাপার হয়তো সেটি হবে না। কিন্তু কিছু হবে। আর প্রচুর খেলা হবে। তাহলে ছেলেরা যেমন খেলায় থাকবে, তেমনি নতুন প্রতিভাও প্রচুর উঠে আসবে।”

বহুল আলোচিত আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থাগুলোর এই জায়গাটিতে এগিয়ে আসার সুযোগ দেখেন নাজমুল আবেদীন।

“আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা যদি চালু হয়, তাহলে একটি অঞ্চল নিজেরা কিন্তু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট করতে পারে। তিন-চারটি অঞ্চল যদি নিজেরা করতে পারে সময়টা ঠিকঠাক রেখে, তাহলে তৃণমূল থেকে প্রচুর ক্রিকেটার উঠে আসতে পারে। শুধু টি-টোয়েন্টিই নয়, ৫০ ওভার বা যে কোনো ফরম্যাট হতে পারে। তাহলে নিয়মিত ক্রিকেটাররা খেলার মধ্যে থাকবে, নতুন ক্রিকেটার উঠে আসবে। নিয়মই করে দেওয়া যেতে পারে, স্থানীয় ক্রিকেটার খেলাতে হবে ৭-৮  জন।”

“শুধু ক্রিকেটার উঠে আসাই নয়, পাশাপাশি আরও কিছুর উন্নতি হবে। খেলা থাকা মানেই ভালো কোচ তৈরি হবে, মাঠ তৈরি থাকবে, মাঠ তৈরি করার লোক থাকবে, খেলাকে ঘিরে আরও অনেক কিছুর উন্নতি হবে।”