’পলাতক’ তারেক বাংলাদেশকে কী দিতে পারে?

’পলাতক’ তারেক বাংলাদেশকে কী দিতে পারে?

রশীদ হায়দার:

২০০৮ সালে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন তারেক রহমান। প্যারোলে মুক্ত হয়ে লন্ডন গিয়ে আর ফিরে আসেননি দেশে। সেখানে পলাতক থাকা অবস্থায় তাকে নেতা বানানোর জন্য নিজেদের গঠনতন্ত্রের ৭- এর ‘ক’ ধারা সংশোধন করে বিএনপি যে ধারায় বলা ছিল কোনো দণ্ডিত ব্যক্তি দলের নেতা হতে পারবেন না। এই সংশোধনের মাধ্যমে তিনি বিএনপির নেতা হয়ে আছেন বটে কিন্তু প্রশ্ন হলো- আজকের বাংলাদেশকে কতটুকু চেনেন তারেক রহমান। 

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ বদলে গেছে। বদলে গেছে রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতি। দূর দেশে বসে কেবল নিজ দলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই দেশের জনগণের জন্য কী করতে পারবেন তিনি।

গেল ১৫ বছর বাংলাদেশের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক বছর। এরইমধ্যে চালু হয়েছে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু। পদ্মারেলসেতুও প্রস্তুত উদ্বোধনের জন্য। অনেক ষড়যন্ত্রের জাল আর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করেছি। এই সেতু দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে সরাসরি রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। চালু হয়েছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বাংলাদেশের মানুষে পেতে যাচ্ছে বিমানবন্দরে আধুনিক থার্ড টার্মিনাল। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে চালু হবে দেশের প্রথম টানেল। একের পর এক অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাংলাদেশকে যেমন পৌঁছে দিয়েছে অন্যমাত্রায় ঠিক তেমনই বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকেও বাড়িয়ে তুলেছে শতগুণ। যে নেতা গত ১৫ বছরে এগিয়ে যাওয়া এই বাংলাদেশ নিজ চোখে দেখেনি, যে নেতা কোভিড-১৯ এর মতো কঠিন মহামারি কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় তা বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেখেননি, সেই নেতা ঠিক কী কী আশার বাণী নিয়ে আসবেন? সে কার নেতা হবেন?

মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী  বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও ব্যবসায়ীক অংশিদার গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে  ঘুষ ও মানি লন্ডারিং নিয়ে  তদন্ত করেছে এবং বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এফবিআইয়ের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি। এফবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে যে, তারেক ও মামুন তাদের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের পরিচালক এবং চীনের হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন এর এদেশীয় এজেন্ট খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নিয়েছিল। হারবিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির লোকাল এজেন্ট হিসেবে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের কাজ পাওয়ার  জন্য তারেক ও মামুনকে ওই টাকা দিয়েছিল ঘুষ হিসেবে। এফবিআইয়ের এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ এই বিষয়ে তারেক  ও মামুনের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছিলেন।

চলতি বছর ২ অগাস্ট জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা এক মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নয় বছর এবং তার স্ত্রী জুবাইদা রহমানের তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত। তাকে কারাদণ্ডের পাশাপাশি তিন কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এটি না দিলে তাকে আরও তিন মাস সাজা ভোগ করতে হবে।

২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি তারেক রহমানকে ভয়ঙ্কর রাজনীতিক এবং দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতা সম্পন্ন রাজনীতির প্রতীক উল্লেখ করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বার্তায় তারেকের যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশের নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করা হয়। সাড়া জাগানো ওয়েবসাইট উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন নথি থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।

কী পেতে পারে এদেশের মানুষ সেসকথা বলতে গিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে, রাজপথে সহিংসতা এবং সারাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কথা আমরা ভুলিনি। যে মানুষ আমাদের কথা ভাবে না, যে মানুষ বিদেশে বসে এখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর উসকানি দেয় তার কাছে আমাদের কিছু পাওয়ার নেই।’ তিনি বলেন, ‘২০১৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত শতাধিক পরিবারকে আক্রমণ করা হয়েছিল, সম্পত্তি লুট করা হয়েছিল এবং উপাসনালয়গুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তারেক রহমান ওখানে বসে যা বলেন তা আমরা হুমকি হিসেবেই দেখি। আর এই হুমকি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য উদ্বেগজনক।’

পলাতকের আইনি অধিকার কতটুকু?
কোনো পলাতক আসামি আইনের আশ্রয় পেতে পারে না বলে ২০২১ সালে মন্তব্য করেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একটি হত্যা মামলার আপিল শুনানিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ এই মন্তব্য করেন। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন, বিচারপতি মুহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

পলাতক ব্যক্তির আইনের আশ্রয় লাভের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও আইন অনুযায়ী কখনো কোনো ব্যক্তি আদালতে আত্মসমর্পণ না করে কোনো ধরনের আইনগত প্রতিকার চাইতে পারেন না।

তারেক রহমান কেবল কারাগারে যাওয়ার শঙ্কায় দেশে আসেননি। যদি তিনি দেশের মানুষদের ভালো থাকা নিয়ে ভাবতেন তাহলে তিনি আইনি লড়াই লড়তে ভয় পেতেন না। বয়সজনিত নানা জটিলতায় ভয়াবহ অসুস্থ তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দেখতেও তিনি দেশে ফিরতে চাননি কখনও। সেই মানুষ এই দেশের ১৮কোটি মানুষকে নিয়ে ভাবতে চান – একথা অবিশ্বাস্য। 

এই পলাতক নেতা বর্তমান জটিল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র পরিচালনা করার মতো করে নিজেকে তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। বতর্মান বাংলাদেশকে বুঝে নিয়ে দেশ পরিচালনার কোনো যোগ্যতা নেই, দক্ষতা নেই, সক্ষমতা তার নেই। তারেক রহমান তথা বিএনপি যিদি ভেবে থাকে হত্যা, কু, নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বিদেশি প্রভুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ক্ষমতায় আসতে পারবে তাহলে ভুল কর্মপরিকল্পনার দিকে ধাবিত হচ্ছে, এটা বলাই যায়।