অসাধু উদ্দেশ্যে নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে ছড়ানো হচ্ছে গুজব
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ দাবি করে ছড়ানো হচ্ছে নানারকম ভিডিও। নানা কুরুচিপূর্ণ ক্যাপশনে এসব ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জারে শেয়ার করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব ভিডিওর কোনটিই নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ নয়।
টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই, ব্যাঙ লাফ দিতে দিতে আবৃত্তি, জংলি সাজে উদ্ভট ভাষায় অভিনয়— সম্প্রতি নতুন শিক্ষাক্রমের অংশ হিসেবে এসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কিছু ভিডিও অনেক আগে রেকর্ড করা। ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিও প্রতিবেশী দেশ ভারতের অসম রাজ্যের স্কুলের।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, টিরিং টিরিং সাইকেল চালাই শিরোনামের সবচেয়ে আলোচিত এই ভিডিওটি আসমের ধুবরি জেলার শিক্ষক প্রশিক্ষণের একটি ভিডিও। অসমের বিভিন্ন স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন যানবাহন সম্পর্কে পরিচিত করে তুলতে এই কবিতাটি পড়ানো হয় এবং ঐ অঞ্চলে এটি ‘ভঙ্গিমা গীতি’ হিসেবে পরিচিত। হাঁসের ডাক দিতে দিতে হাঁটা শিরোনামের ভিডিওটি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় গতবছরের অক্টোবর-নভেম্বরে শিক্ষক প্রশিক্ষণের। গণিত অলিম্পিয়াড প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে ম্যানুয়াল অনুযায়ী এ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থীদেরকে ঘরের কাজ শেখানো ও রান্নাবান্না শেখানোর বিষয়টি নিয়েও বিদ্রুপ করছেন অনেকে। অথচ আমরা জানি, এদেশে নিজের কাজ নিজে করে না বেশিরভাগ শিশু। নারী-পুরুষভেদে সকলেরই যে জীবনে চলার জন্য বেসিক লাইফ স্কিল জানা থাকা উচিৎ, সে ব্যাপারে সচেতন নয় পরিবার বা সমাজ।
কী কারণে এই ভিডিওগুলো নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদেরা বলছেন দেশে কোচিং, নোট আর গাইডবইয়ের ব্যবসার বাজার কয়েক হাজার কোটি টাকা। তারা সবসময় কারিকুলামের সমালোচনা তুলে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরী করতে চায়। চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে শিক্ষার্থীরা আর নোট গাইড নির্ভর হবে না। বিষয়ভিত্তিক কোচিং বন্ধ হলে তাদের কী হবে?
শিক্ষাক্রম নিয়ে কাজ করেছেন এমন একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আগামীর উন্নত বাংলাদেশের জন্য এই কারিকুলামের বিকল্প নেই। এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষার্থীরা নিজে শিখবে, আর শিক্ষক সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করবেন। মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার বাইরে এসে হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে, দলগত কাজের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে সহযোগিতার মনোভাব। কোনো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা নিজে অনুসন্ধান করছে, স্ব-প্রণোদিত হয়ে কাজ করায় পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ বজায় থাকছে। যারা চায় না শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হোক, যাদের সন্তানেরা বিদেশে পড়ালেখা করে তাদের সমালোচনার হার বেশি।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ব্যাপকভাবে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। যেগুলো আমাদের প্রশিক্ষণের অংশ নয়, সেগুলো ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠী স্বার্থহানি হওয়ার ভয়ে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। যাদের স্বার্থহানি হচ্ছে তারা বিরোধিতা করছে। তাছাড়া নির্বাচনের ক্ষেত্রে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকে, তাদের উসকানি যুক্ত হয়ে গেছে। অতি-ডান, অতি-বামের উসকানিও যুক্ত হয়ে গেছে। সবচেয়ে খারাপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে মিথ্যাচার।
শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান বলেন, ‘প্রথম দিকে বিরোধিতাকারীরা যে অ্যাপ্রোচ নিয়েছিল তা হচ্ছে—শিক্ষাক্রমের ভুল কিছু ধরা যায় কিনা? নানা যুক্তি দিয়ে ভালনারেবল অবস্থায় নেওয়া যায় কিনা? তাদের সেই চেষ্টার পর আমরা যখন ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করলাম, শিক্ষামন্ত্রীও ব্যাখ্যা করেছেন, তখন তারা ভিন্ন অ্যাপ্রোচে চলে গেলো। মিথ্যাচার ছাড়াও অনেক ডাইমেনশন রয়েছে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, শিক্ষকদের বিরোধিতায় নেওয়া যায় কিনা, মানুষের কাছে খেলো হিসেবে শিক্ষাক্রমকে উপস্থাপন করা যায় কিনা? এসব উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে।