সার উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ল বাংলাদেশের

সার উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ল বাংলাদেশের

বিশেষ প্রতিবেদক

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে বর্তমানে ইউরিয়া সারের চাহিদা বছরে ২৬ লাখ টন। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী (বিসিআইসি)  এতদিন আমাদের দেশি কারখানায় সার উৎপাদন হতো ১০ লাখ টন। বাকিটা আমদানি করতে হতো। রোববার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করলেন, নরসিংদীর ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা। প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক বললেন, দৈনিক ২ হাজার ৮০০ টন এবং বছরে প্রায় ১০ লক্ষ টন সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে এই কারখানার। এখানে পুরোপুরি  উৎপাদন শুরু হলে দেশে সার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়াবে ২০ লক্ষ টন। প্রকল্পের নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার দুই মাস আগেই কাজ শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে পরীক্ষা মূলক উৎপাদনও শুরু হয়েছে।  

বিসিআইসির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, দেশের কৃষি খাতের মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ ইউরিয়া সার উৎপাদন করবে ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানা। দেশি সার দিয়ে মোট চাহিদা পূরণের বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানায় পুরোপুরে উৎপাদন শুরু হলেই আমদানি নির্ভরতা চোখে পড়ার মত কমে যাবে। বিসিআইসির এই কারখানায় প্রতিবছর প্রায় ৯ লাখ ২৪ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হবে। যা দেশের মোট ইউরিয়া চাহিদার ৩৫ শতাংশ।

সাইদুর রহমান আরো জানান, ঘোড়াশাল-পলাশ সার কারখানাটি পুরোদমে চালু হলে দেশে ইউরিয়া সারের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে ২০ লক্ষ মেট্রিক টন হবে। এতে করে আমদানি নির্ভরতা পাঁচ ভাগের এক ভাগে নেমে আসবে। এর ফলে বিদেশ থেকে সার আমদানিতে যে টাকা ব্যয় হয়, সেখান থেকে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার সাশ্রয় হবে। ইউরিয়া সার আমদানিতে ভর্তুকি দিতে হবে না । এখন পর্যন্ত সরকারকে ইউরিয়া আমদানিতে প্রতি বছর ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়।  কারখানাটি দেশের কৃষি উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যে এবং সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে । এছাড়া কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

কারখানার প্রকল্প পরিচালক জানান, এই কারখানাটিকে গ্রিন ফার্টিলাইজার প্রকল্পও বলা হচ্ছে। এখানে পরিবেশ দূষণ হওয়ার সুযোগ নেই। পরিবেশ দূষণের যে কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস বের হবে তা ধরে রেখে আবার ব্যবহার করে ১০ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আধুনিক যে প্রযুক্তি এখানে যুক্ত করা হয়েছে তা দেশি প্রকৌশলীরা চালাবেন। বর্তমানে জাপানি কনসালটেন্টদের মাধ্যমে দেশের প্রত্যেকটা কর্মকর্তা ও অপারেটরকে ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। এখন দেশি কর্মীরাই অপারেশন সিস্টেম চালাচ্ছে আর বিদেশিরা পর্যবেক্ষণ করছে। কোনোরকম ভুল হলে তারা সেটা ধরিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে।

প্রকল্প পরিচালকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কারখানাটির প্রযুক্তি অত্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয়ী। পলাশ ও ঘোড়াশালের পুরোনো দুটি কারখানায় আগে যে পরিমাণ গ্যাস লাগত, একই পরিমাণ গ্যাস দিয়ে নতুন কারখানায় আগের চেয়ে তিনগুণ উৎপাদন করতে পারবে। বর্তমানে কারখানা চালু রাখতে দৈনিক বিদ্যুৎ দরকার হবে ২৮ মেগাওয়াট। যেখানে ৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ২টি অত্যাধুনিক স্টিম গ্যাস জেনারেটর রয়েছে। জেনারেটর দুটি সবসময় ৫০ শতাংশ লোডে চলবে। তাই এই কারখানাটির ২টি স্টিম গ্যাস জেনারেটর ১০০ শতাংশ লোডে চালিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা সম্ভব হবে।

কারখানায় উদ্বৃত্ত সার মজুদ করার জন্য থাকছে ১ লক্ষ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক বাল্ক স্টোরেজ।  এমনকি বেঁচে যাওয়া এমোনিয়া স্টোরেজের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে অত্যাধুনিক স্টোরেজ ট্যাঙ্ক । লিকেজ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য কারখানাটিতে রয়েছে সয়ংক্রিয় ওয়াটার পন্ড এবং ওয়াটার কার্ডেন।

বিসিআইসির নথি বলছে, দেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে বার্ষিক ৩ লাখ ৪০ হাজার এবং ১৯৮৫ সালে ৯৫ হাজার টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন যথাক্রমে ঘোড়াশাল এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপিত হয়। কারখানা দুটি অত্যন্ত পুরোনো হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস এবং ডাউন টাইম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানা দুটির স্থানে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী, পরিবেশ বান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি সার কারখানা নির্মাণের নির্দেশ দেন। কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে সার পৌঁছানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর দুটি কারখানা একত্র করে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।

এই প্রকল্প নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা, জানান, দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইউরিয়া সার কারখানা এটি। এর নির্মাণ ব্যয় ১৫ হাজার ৫শ কোটি টাকা। কয়েকটি বিষয় মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করতে বলেন, এগুলো হচ্ছে, দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সারের চাহিদা মেটানো, সুলভ মূল্যে কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ, আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি। মোট ব্যায় মেটাতে  সরকারি তহবিল থেকে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। বাকি ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকা বাণিজ্যিক ঋণ। 

এর আগে ২০১৬ সালে, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে শক্তিসাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির শাহজালাল সার কারখানা উদ্বোধন করা হয়। এটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫ লাখ ৮০ হাজার ৮শ মেট্রিক টন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালের অক্টোবরে নরসিংদী জেলায় ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু করোনার কারণে ২০২০ সালে এই কাজ সাময়িক ধীরগতি আসে। ৪৩৬ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এই কারখানা । এর মধ্যে শুধু ১১০ একর জমির ওপর কারখানাটির মেশিনারিজ বসানো হয়েছে। বাকি ৩২৬ একর জমির ওপর অফিস, শ্রমিকদের আবাসন প্রকল্পসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ করা হবে।