আগুন সন্ত্রাসের ছোবলে বার্ণ ইন্সটিটিউটে কাতরাচ্ছে নিম্ন আয়ের সাতজন
রিকশাচালক আব্দুল জব্বার দিনভর রিকশা চালিয়েও সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন। তার বড় ভাইয়ের পরামর্শে পরিবারকে পাঠিয়ে দেন নারায়ণগঞ্জে কাজের উদ্দেশ্যে। সারাদিন রিকশা চালিয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে রাতে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসে রওনা হলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আগুন সন্ত্রাসের কবলে পড়েন তিনি। আর নিমিষেই ঘুরে দাঁড়ানোর সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যায়। রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের বিছানায় এখন কাতরাচ্ছেন তিনি। তার শরীরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
জব্বারের মতো বিএনপি ও সমমনাদের ডাকা চলমান অবরোধে আগুনে পুড়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে চিকিৎসাধীন আছেন সাতজন। তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কেউ পেশায় গার্মেন্টস শ্রমিক, পরিবরহন শ্রমিক কিংবা দিনমজুর। আগুন সন্ত্রাসের কবলে পড়ে যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা কেউই শংকামুক্ত নন বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা সামন্ত লাল।
আগুনে পুড়ে হতাহতরা হচ্ছেন- পোষাক শ্রমিক মো: মাহমুদ হাসান (২৩), মেরাদিয়ার পরিবহন শ্রমিক সবুজ মিয়া (৩০), কালীগঞ্জে কাভার্ডভ্যানে অবস্থানরত বিপ্রজীদ ভাওয়ালী (২০), কাকরাইলে শ্রমিক শাখাওয়াত হোসেন (২৮), ডেমরায় বাসে ঘুমন্ত থাকা হেলপার মো. রবিউল ইসলাম রবি (২৫) এবং মানিক দাস (৪৫) নামে বিমানের এক ক্লিনার।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম জানান, পেট্রোলে দগ্ধের কারণে তাদের শরীরে ক্ষতগুলো গভীর। তাদের অনেকেরই অপারেশনের প্রয়োজন হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকের চামড়া লাগাতে হচ্ছে। আমরা তাদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি।
দগ্ধদের মধ্যে, জব্বারের ২০ শতাংশ, হাসানের ১১ শতাংশ, সবুজের ২৮ শতাংশ, বিপ্রজীত এর ৭ শতাংশ, শাখাওয়াত এর ১০ শতাংশ, রবির ১৭ শতাংশ দগ্ধ এবং মানিক দাসের ৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।
যাত্রাবাড়ীতে গত শনিবার (১১ নভেম্বর) রাতে অনাবিল পরিবহনের বাসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বাসযাত্রী দগ্ধ রিকশা চালক আব্দুল জব্বার ও গার্মেন্টেস কর্মী মাহমুদ হাসান দগ্ধ হন। ওই রাতেই তাদের বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। জব্বারের বড় ভাই জিকরুল ইসলাম জানান, জব্বার রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে পারতো না। সংসারে অভাব লেগেই থাকতো। তাই শনিবার তার পরিবারকে কাজের উদ্দেশ্যে সকালে আমার বাসায় নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসি। জব্বার তার কাজ শেষ করে রাতে আমার বাসার উদ্দেশে বাসে চড়ে। পথে যাত্রবাড়ীতে আগুনে দগ্ধ হয়।
তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ নিজের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এর মধ্যে আবার ভাই দগ্ধ হয়েছে। তার চিকিৎসা করার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতায় চিকিৎসা চালাতে হচ্ছে।
একই বাসে দগ্ধ হওয়া যাত্রী মাহমুদুল হাসান জানান, আমার এক বন্ধুর মোবাইল ফোন কিনতে বসুন্ধরা মার্কেটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে তাকে দিয়ে কমলাপুর থেকে বাসে উঠে মাঝামাঝি বসেছিলাম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় বাসটি আসার পর হঠাৎ দেখি আমার পায়ের নিচ দিয়ে আগুন লেগে গেছে। পরে দ্রুত ওই সিট থেকে কোনরকমে বের হয়ে যাই। ততোক্ষণে আমার দুই পা ও ডান হাত ঝলসে গেছে।
অন্যান্যদিনের মতোই রমজান পরিবহনের বাস চালক সবুজ মিয়া অছিম পরিবহনে করে বাসা থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন। পথে মেরাদিয়া বাঁশপট্টির কিছু আগে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ঝলসে যান তিনি। তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে নিয়ে আসা হয়। শরীরে পোড়া ক্ষত নিয়ে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের শয্যায় এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাতরাচ্ছেন সবুজ মিয়া। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বলতে তিনিই আছেন বলে জানান তার স্ত্রী। কিন্তু রোজগার বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়ে স্বজন আর পরিচিতজনদের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। কবে সুস্থ হয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিতে পারবেন এবং আয়ে ফিরবেন সেই দুশ্চিন্তায় দিন পার করতে হচ্ছে তার পরিবারকে।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচিকে ঘিরে সংঘর্ষের পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এরপর থেকে হরতাল এবং দফায় দফায় ডাকা অবরোধে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া শুরু হয়। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে ২৮ অক্টোবর থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে।
বাসে আগুনের ঘটনায় একজন পরিবহনকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। গত ২৯ অক্টোবর ভোরে ডেমরার দেইল্লা বাস স্টেশনে রাস্তার পাশে রাখা অছিম পরিবহনের একটি বাসে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা যান ওই বাসের হেলপার নাঈম। ওই ঘটনায় দগ্ধ হন নাঈমের বন্ধু আরেকটি বাসের হেলপার রবিউল ইসলাম রবি।
অন্য দিকে, গত ৮ নভেম্বর ভোরে গাজীপুরের কালীগঞ্জে কাভার্ডভ্যানে আগুন দেন দুর্বৃত্তরা। ওই ভ্যানে থাকা বিপ্রজীত ভাওয়ালী ও আনোয়ার নামে দুইজন দগ্ধ হন। তাদের উদ্ধার করে প্রথমে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আনোয়ার বাসায় চলে যান। বিপ্রজীত চিকিৎসাধীন আছেন। পরে তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে স্থানান্তর করা হয়।
বার্ণ ইনস্টিটিউটে তার মা স্বপ্না ভাওয়ালী তার পাশে বসে থাকেন। বিপ্রজীত ভাওয়ালী জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বগুড়ায় তাদের কোম্পানির গাড়ির সমস্যা হয়। তাই সেখানে গিয়েছিলেন, সেখানে গাড়ির কাজ শেষ করে একই কোম্পানির একটি কাভার্ডভ্যান যোগে ফেরার পথে, কালিগঞ্জ এলাকায় রাস্তায় ৯/১০ জন তাদের গাড়িটিকে পথরোধ করে ভাঙ্গচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। গাড়ি থেকে নামতে নামতে শরীরের আগুন ধরে যায়।
রবিবার (১২ নভেম্বর) রাতে দগ্ধ হন বিমানের ক্লিনার মানিক দাস। রাজধানীর বনানী এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি স্টাফ বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তাতে তিনি দগ্ধ হন। তিনি জানান, রাতে এয়ারপোর্টে ডিউটি শেষে ২০-২৫ জন কর্মী বিমানের স্টাফ বাসে করে বাসায় ফিরছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে বনানীতে ঢোকার সময় জানালা দিয়ে তরল পদার্থ ছুড়ে মারা হয়। এতে গাড়িতে আগুন ধরে গেলে তার ডান হাত ও বাম পা দগ্ধ হয়। পরে ওই বাসে থাকা তপু নামে এক সহকর্মী তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে।
তিনি আরও জানান, এই ঘটনায় ওই বাসে থাকা আরও পাঁচ ছয় জন আহত হয়েছে। তবে কোথায় তাদের চিকিৎসা চলছে তা বলতে পারেননি।
ডা সামন্ত লাল সেন বলেন, কয়েকজনের ২৭-২৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। পেট্রোলের কারনে বাকিদের ক্ষত বেশি। তাদের অপারেশনেরও প্রয়োজন আছে। তারা সবাই নিম্নআয়ের মানুষ। তারা তো সহজে সুস্থ হবে না। তাদের অন্তত মাসখানেক কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।