একজন পরিচ্ছন্ন এবং পরিপূর্ণ রাজনীতিকের প্রতিক
সিরাজুল ইসলাম তছলু: বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সিলেট-৩ আসনের একাধিকবার নির্বাচিত মাননীয় সাংসদ। জাতীয় সংসদের বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সদস্য। শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। সর্বোপরি সিলেট আওয়ামী লীগের প্রথম সারির একজন নেতা।
সদ্যপ্রয়াত আলহাজ মাহমুদ-উস-সামাদ চৌধুরী কয়েস-এর মৃত্যুতে তার নির্বাচনী এলাকাসহ বৃহত্তর ও সিলেটের মানুষের যে ক্ষতি হয়েছে এর শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়। তার ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক জীবন খুবই পরিচ্ছন্ন । একজন স্মার্ট জনপ্রতিনিধি। ছিলেন স্বাস্থ্য সচেতন। রুটিনমাফিক চলাফেরা করতেন। সেই মানুষটি করোনার ছোবলে এতো কম সময়ে বিদায় নিলেন, সেটা ভাবতেই কষ্ট হয়। দলমত নির্বিশেষ তার জানাজায় অশ্রুভেজা মানুষের ঢল প্রমাণ করে তিনি সিলেটবাসীর কত প্রিয় জননেতা।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলেও তিনি একজন ব্রিটিশ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত এবং সেই আলো-বাতাসে, সভ্যতার একদম শেখড়ে বড় হওয়া আত্মবিশ্বাসী মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখা পছন্দ করতেন। ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অর্থ-বিত্তের মালিক, বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী জনাব কয়েস চৌধুরী। যুক্তরাজ্যে নিজের হাতেগড়া ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা চাইলে ব্রিটিশ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হতে পারতেন। কিন্তু আমাদের রক্তঝরা স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের প্রতি অবিচল ভালোবাসার টানেই ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু ভাইয়ের হাতে ছেড়ে দিয়ে নাড়ি পোঁতা মাটির টানে পাড়ি জমান প্রিয় স্বদেশে।
দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং আংশিক বালাগঞ্জ নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যুক্তরাজ্যে আসার পর কোনো এক সন্ধ্যায় ব্রিস্টল শহরে তার সাথে সাক্ষাতের সময় দিলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক জনাব মিছবাউর রহমান মিছবাহ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সভাপতি কামাল আহমেদ, মাওলানা রশিদ আহমদ এবং আমি সাক্ষাৎ করতে যাই। সময়টাকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। বিকেল ৫ ঘটিকার আগেই আমরা তার রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হলাম। খুবই অতিথিপরায়ণ একজন মানুষ। আমাদের খুব আপন করে ঘুরে দেখালেন। কলেজ পড়ুয়া অবস্থায় তার নিজের হাতে গড়া রেস্টুরেন্ট।
তার মনের মাধুরি দিয়ে সাজানো নান্দনিক রেস্টুরেন্টে প্রায় ছয় ঘণ্টা কাটালাম। একই টেবিলে বসে রাতের খাবার খেলাম। তার জীবনের শুরু থেকে তখন পর্যন্ত পারিবারিক, ব্যবসায়ীক এবং রাজনৈতিক সমস্ত কিছু একদম মন খুলে আমাদের সাথে শেয়ার করলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার যোগসূত্র, তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের কল্যাণে কিভাবে কাজ করা। সর্বোপরি ডেভোলপমেন্টের দিক থেকে তার নির্বাচনী এলাকাকে কিভাবে সাজাবেন সেক্ষেত্রে তিনি একটা ভিশন নিয়ে কাজ করছেন। এ সমস্ত বেশ কিছু তথ্য আমাদের সামনে উপস্থাপন করলেন।
যেমন তার পোশাক-আশাক তেমন তার কথাবার্তা। জনাব কয়েস চৌধুরী অনেক গোছানো এবং মার্জিত কথাগুলো বলছিলেন। আর আমরা অবাক বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে, প্রাণবন্ত কথাগুলো শুনছিলাম। একজন আরাম-আয়েশ করা কয়েস চৌধুরী নির্ঘাত পিছনে পড়ে যাওয়া জেনেও তার ভিশন বাস্তবায়ন করতে অনেকটা নিজের সাথে চ্যালেঞ্জ করে পিচ্ছিল পথ অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলেন। হোঁচটও খেলেন কিন্তু কাউকে বুঝে ওঠার আগেই নিজেকে সামলে নিলেন। একজন প্রতিশ্রুতিশীল মানুষ হিসেবে নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছেন। জোট সরকারের আমলে নেতাকর্মীদের মামলা-হামলায় সবসময় পাশে থেকেছেন। নিজের খরচে দলের কর্মীদের হাইকোর্টে জামিন করিয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনে গরিব রিকশাচালক, শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের জন্য তাদের বাসা-বাড়িতে খাবার পাঠিয়েছেন। পরে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার আহ্বান করেছেন। দলের দুর্দিন-দুঃসময়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করেছেন। এমন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদের অভাব আমাদের কখনোই পূরণ হবার নয়।
ভোটের রাজনীতিতে বালাগঞ্জের মানুষের সাথে তার সম্পর্ক সুদীর্ঘ দিনের না হলেও খুব কম সময়ে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। আমার এলাকার একটি রাস্তা তাজপুর-বালাগঞ্জ রাস্তা হতে তিলকচানপুর গুপকানু হয়ে সিলেট-সুলতানপুর-বালাগঞ্জ রাস্তা পুনর্নির্মাণ ও পাকাকরণ , বড়ভাঙ্গা নদীর দুই পাড়ের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি। তাদের এই দাবির পক্ষে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম শহরে যে সকল মাননীয় সাংসদ এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তাটির দাবি উপস্থাপন করেছি এবং দরখাস্ত দিয়েছি। আশ্বাস পেয়েছি কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এপ্রিল ২০১৯ আমি বাংলাদেশে ছিলাম। ওই সময় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অফিসের কর্মকর্তাদের দিয়ে মাপজোখ করে একটা প্রকল্প প্রস্তাব তৈরী করেছিলাম। এই প্রকল্পটি মাননীয় সাংসদের সামনে উপস্থাপন করলে তিনি আইআরআইডিপি-৩ এর আওতায় প্রায় ৬০ লাখ টাকা অনুদান দেন। এক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব মোস্তাকুর রহমান মফুর এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সনম্পাদক নাসির উদ্দিনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো- আমি মাননীয় সাংসদকে একটি অভিনন্দনবার্তা পাঠাবো বলে লিখেছিলাম। সংশ্লিষ্ট এলাকার কিছু মুরব্বিয়ান তিনি বাড়িতে আসলে শুভেচ্ছা জানাতে যাবেন বলে প্রস্তুত ছিলেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে কথা বলেছি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করার আগে মাননীয় সাংসদের উপস্থিতিতে একটি অনুষ্ঠান করব। সকল প্রস্তুতি থাকা সত্তে¡ও তিনি কর্মের ফসল দেখে যেতে পারলেন না। পরম করুণাময় সকল সিদ্ধান্তের মালিক। তিনি যেন আমাদের এই মহান নেতাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন।
বালাগঞ্জবাসীর জন্য তার ভিশনই ছিল কুশিয়ারা নদীর ব্রিজ, পুরাতন হাসপাতালের স্থলে নতুন পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক ভবন, বালাগঞ্জ-পৈপলনপুর-শেরপুর রাস্তা, বালাগঞ্জ সরকারি ডিগ্রি কলেজে অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালুসহ শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সিলেট-সুলতানপুর-বালাগঞ্জ রাস্তাসহ অনেকগুলো প্রকল্প ইতোমধ্যে চলমান এবং বেশকিছু প্রক্রিয়াধীন। আমি আশা করবো- তার স্থলাভিষিক্ত যিনিই হবেন তার অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমাধান করবেন। তিনি একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি যখন অবসর গ্রহণ করবেন, নিজের গ্রামের বাড়িতে নিজ হাতেগড়া মসজিদে নামাজ পড়বেন। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে বেডরুমের জানালা খুলে মসজিদ দেখবেন। সেই অবসর নেওয়ার সুযোগটুকু তিনি পেলেন না। অবসরের আগেই কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় থেমে গেল তাঁর পরিশীলিত জীবন। তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ না হলেও মহান রাব্বুল আলামীনের মহিমায় তাঁর স্বপ্নের মসজিদের পাশেই চিরশায়িত হয়েছেন সাংসদ কয়েস চৌধুরী। পরম করুণাময় যেন তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী। সাবেক সভাপতি, বালাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগ।