ওদের জন্য কি দুঃখবোধ হয়!
যখন বুয়েটের ঘটনা আমাদের আড্ডার আলোচনায় এসেছে, তখন কিছু কথা মাথায় ঘুরাঘুরি করেছে। এই কথাগুলো মনের মধ্যে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে আবরার ফাহাদ হত্যার রায়ের পরে। গত বুধবারে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায় হয়। সেখানে ২০ জন আসামির ফাঁসি এবং ৫ জন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়৷ এই দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের পরিচয় পরিবর্তনের ক্রমটা এমন; তারা প্রথমত শিক্ষার্থী, দ্বিতীয়ত ছাত্রলীগ, তারপরে তৃতীয়ত খুনি।
বিচারক এ মামলার রায়ে যা বলেছেন তা পত্রিকাগুলো এভাবে তুলে ধরেছেন, 'হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আসামিদের সবার সংশ্নিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে পরস্পর যোগসাজশে আসামিরা একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে গুজব ছড়িয়ে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই নৃশংস ঘটনা দেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। এমন মেধাবী ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ভবিষ্যতে যেন আর কখনও না ঘটে তা প্রতিরোধে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় দেওয়া হলো।' (সমকাল)
এখানে বলা হয়েছে মেধাবী ছাত্রের হত্যাকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তার প্রতিরোধে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি। যেই আসামিদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে তারাও তো মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলো। এখন তারা খুনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমরা ভর্তি হই তখন আমাদের পিছনে আমাদের অভিভাবকদের একটা চেষ্টা থাকে, একটা সংগ্রাম থাকে। ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারলে তারা গর্ববোধ করেন। মানুষ তাদের আরেকটু সম্মানিত চোখে দেখেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আমাদের কেউ হচ্ছেন খুন, আবার কেউ কেউ খুনি হয়ে যাচ্ছে। এই খুনি হবার পিছনের কারণগুলো কি কি?
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র রাজনীতির ঘাটাঘাটি করলে দেখা যায়, দেশে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, তখন সেই দলের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসের অনেক কিছুর উপর প্রভাব খাটানোর চেষ্টা চালায়৷ বুয়েটে আবরার হত্যার পরে এক শিক্ষার্থী বলছে এভাবে, 'ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্য বা কোন সাধারণ বিবাদের ঘটনা নিয়ে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের হাতে মারধরের ঘটনাও নিয়মিত ব্যাপার ছিল।' (বিবিসি)
এদিকে হলে শিক্ষার্থী নির্যাতনের বিষয় জানতেন প্রশাসন। নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রশাসনের কাছে বিচার দিয়ে অধিকাংশই কোনো বিচার পায় না। উল্টো তাদের অনেককে হল ছাড়তে হয়। সে সময়ের খবরের কাগজ থেকে জানা যায়, 'ছাত্রদের নির্যাতনের বিষয়ে বুয়েটের প্রতিটি হলের প্রভোস্টরা জানতেন কিন্তু তারা ছিলেন ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে অসহায়। যা প্রকাশও করেছেন আবরার হত্যার এক দিন পর। বুয়েটের এক শিক্ষক বলেন, আমাদের চেয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।' (সময়ের আলো)
বিষয়টা যদি উল্টো হতো। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে প্রথম বাঁধা পেয়েছে যেদিন, এই অসহায়ত্ব যদি সেদিন প্রকাশ পেত। হলে হলে এমন অপরাধ হয়, এটা জানার পরেই যদি শাস্তি পেত অপরাধীরা। তাহলে হয় তো তাদের অপরাধগুলো সেখানেই থেমে যেত। বিন্দু বিন্দু পানি দিয়ে বিশাল সিন্ধুর তৈরি হয়। এটা যেমন ভালো কাজের ক্ষেত্রে ঘটে তেমনই খারাপ কাজের ক্ষেত্রেও তাই। ছোট ছোট অপরাধ থেকে পার পেয়ে যাওয়া সুযোগ হয়তো তাদেরকে খুনি পর্যন্ত নিয়ে গেছে। ছোট্ট এ বিষয় সহজ হলেও প্রশাসনের এ ব্যাপারে 'কাণ্ডজ্ঞান' নেই। জ্ঞানী হইলেই 'কাণ্ডজ্ঞানী' হইবেন এমন কোন চিরন্তন সত্য নাই।
সে সময় গণমাধ্যমে এসেছে, আবরারকে শিবির সন্দেহে মারা হয়েছে। এই কথাটা হয়তো অনেকটা সহজ করে দেয়, যে শিবির করলে কাউকে মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি ভিন্নমত প্রকাশ করা অপরাধ হয়, প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে; এরপরে রাষ্ট্রের আইনে বিচার হবে। কিন্তু কেউ কাউকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করবে, মেরে ফেলবে এই অধিকার কাহারো নেই। একটা শিশু পৃথিবীতে জন্ম নিলে; সেটা হোক বৈধ কিংবা অবৈধ তাঁকে হত্যা করার অধিকার যেমন কাহারো নেই। বরং সমাজে অন্যদের প্রতি দায়িত্ব বর্তায় তার বাঁচার অধিকার নিশ্চিত করার। তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রতিটি শিক্ষার্থীর সে যেই মতেরই হোক না কেন, তার অভিভাবক আমাদের শিক্ষক এবং প্রশাসন। আমাদের ভালোর পথ দেখাবেন এটা তাদের দায়িত্ব।
আবরার হত্যার পরে ওখানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আওয়াজ ওঠে এবং শেষমেশ বন্ধ হয়। কিন্তু আমাদের দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতি বিশাল একটা অংশ জুড়ে রয়েছে। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে অপরাধ করলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে দেওয়া অনেকটা মাথাব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার মতো। অন্যদিকে এই রাজনীতিতে জড়িয়ে ছোট ছোট অপরাধগুলো একদিন বড় অপরাধে পরিণত হচ্ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বের জায়গা থেকে প্রশাসন সঠিক দায়িত্ব পালন না করায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। বড় অপরাধের সুযোগ তৈরি হয়। যে গলিতে অন্ধকারের জন্ম, সেই গলির মুখ বন্ধ না করলে কখনো অন্ধকার দূর হবে না। আবারও বলতে হয়, প্রশাসন প্রথমেই তাদের ছোট অপরাধের শাস্তি দিলে, বিচারের আওতায় নিয়ে আসলে এভাবে কোনো মায়ের বুক খালি হতো না। কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিচয় খুনি হতো না।
আরেকটা বিষয় মনে পড়ছে এই সময়ে, সবাই খুনিদের কথা বলছে। কিন্তু যারা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন না করে, এদেরকে খুনি হওয়ার সুযোগ করে দিসে তাদের কথা বলছে না। এখন আমার জানতে ইচ্ছে করে, আমাদের অভিভাবকরা সন্তানদের ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করালে গর্ববোধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা শিক্ষার্থীদের অভিভাবক; তাঁদের ছাত্ররা খুনিতে পরিণত হয়েছে, এখানে আপনাদের কি কোনো দুঃখবোধ হয়?
শঙ্খনীল কারাগার থেকে,
১০ ডিসেম্বর, ২০২১।