ত্রিমুখী সংকটে দুর্ভোগ বাড়ছে হাওরে

ত্রিমুখী সংকটে দুর্ভোগ বাড়ছে হাওরে

হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জের দুঃখ যেন পিছু ছাড়ছে না। ২০১৭ সালের বন্যায় সব ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর নিজেদের সামলে নিতে নিতেই এবার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হাওরের লোকজন।

পাহাড়ি ঢলে জেলায় বোরো ধানসহ অন্য ফসলের ক্ষতি ও মাছ ভেসে যাওয়ার মধ্যেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হাওরের মানুষের জীবনে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়েছে।

মঙ্গলবার জেলার হাওর এলাকা সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, ঢলের পানিতে এখনও ডুবে আছে ফসলের মাঠ। এ সময় স্থানীয় কয়েকজন জানান, এপ্রিল মাসে উজানের ঢলে আধাকাঁচা ধান হারিয়েছেন অনেকে। যেটুকু ধান কোনো রকম ঘরে তুলতে পেরেছেন, এগুলোর দাম নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

এরই মধ্যে হাতে নগদ টাকা না থাকায় খাবারের জোগান নিয়ে বিপাকে পড়েছেন হাওরবাসী। ধানের পাশাপাশি ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বাদামেরও। মাছ ভেসে গেছে অনেক লাখ টাকার।

তাহিরপুরের মাটিয়ান হাওরে ৩ একর জমিতে ধান চাষ করেছিলেন আছমা বেগম। ঢলের পানিতে আধাপাকা ধান ঘরে তুললেও সেই ধানের মূল্য পাবেন কি না, সেটি নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘টাকা ধারদেনা করে জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। কিন্তু অকালে বানের পানিতে সব ধান নষ্ট হয়ে গেছে। আবার ঘরে যে ধান তুলেছি সেগুলোও ভিজে গেছে। এ ধান এখন কিভাবে বিক্রি করব।’

বিশ্বম্ভরপুর ভাদেরটেক গ্রামের কৃষক নূর আলম বলেন, ‘ভারি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ধানসহ আমার ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। আমরা গরিব মানুষ অনেক বিপদে আছি। সরকার সহযোগিতা না করলে মরা ছাড়া উপায় নেই।’

সুনামগঞ্জে এ বছর পাহাড়ি ঢলে ধানের পাশাপাশি মাছ ও বাদামের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি বিভাগের তথ্যে, এ বছর ১ হাজার ২৫০টি পুকুরের মাছ ঢলের পানিতে ভেসে গেছে। ৭০ হেক্টর জমির বাদাম পানিতে পচে গেছে, যার বাজারমূল্য ৩৫ লাখ টাকা।

দোয়ারাবাজার উপজেলা আজমপুরের মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘২০০ টাকা করে বাদামের বীজ কিনেছিলাম। রোপণ করা পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু একটি টাকাও উঠাতে পারব না। এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছিলাম। কিভাবে সেই টাকা শোধ করব সে চিন্তায় আছি।’

মাছ চাষ করে এখন কপালে হাত রফিকুল ইসলাম কালার। তিনি বলেন, ‘ধারদেনা আর ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে প্রায় ১০ লাখ টাকার মাছ ছেড়েছিলাম। ঢলের পানিতে সব ভেসে গেছে। এখন সরকার সহযোগিতা না করলে মারা যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।’

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সীমা রানী বিশ্বাস জানান, জেলার ২০ হাজার ৪৬৯টি পুকুরের মধ্যে ১ হাজার ২৫০টি পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। ১৬ হাজার ৫০০-এর মধ্যে ১ হাজার ১০০ খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৩ কোটি টাকার বড় মাছ ও ৩০ লাখ টাকার পোনা মাছ ভেসে গেছে। ১২ লাখ টাকার অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে।

সুনামগঞ্জের কৃষি বিভাগের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘ঢলের পানিতে অনেক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা তাদের তালিকা তৈরি করেছি। এ তালিকা ধরেই সরকার সহায়তা করবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার ৭০ হেক্টরের মতো জমির বাদামের ক্ষতি হয়েছে। এর দাম প্রায় ৩৫ লাখ টাকা।’

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ফসলের ক্ষতির মধ্যেই বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়ায় হাওরের মানুষের মধ্যে সরকারের ন্যায্যমূল্যে খাবার বিতরণের বিকল্প দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।

কম করে হলেও হাওরপ্রধান উপজেলার ইউনিয়নগুলোতে ৭০ শতাংশ খাবার ন্যায্যমূল্যে দেয়া নিশ্চিত করার দাবি জানান তারা।

হাওর এরিয়া আপ লিফমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, ‘হাওরের মানুষের কাছে এখন নগদ টাকা নেই। ধান রোপণ থেকে তোলা আর বাজারে দাম না পাওয়ায় তারা এখন হাত খালি অবস্থায়। তাই সরকারকে ন্যায্যমূল্যে তাদের মধ্যে খাবার বিতরণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আগামী দিনের চাষাবাদের জন্য টাকা বা বীজ দেয়া হোক।’

হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘ধান আর মাছ সুনামগঞ্জের প্রাণ, তবে এ বছর আগাম ঢলে দুটোরই ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাবে বাঁধভাঙা পানিতে ৫ হাজার হেক্টরের ক্ষতির কথা বললেও বাস্তবে দ্বিগুণ ক্ষতি হয়েছে।

‘তাই কৃষকদের বাঁচাতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা যে ধান গুদামে দিচ্ছেন এর সঠিক দাম দিতে হবে।’

এ বিষয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেবাংশু কুমার সিংহ বলেন, ‘ন্যায্যমূল্যে পণ্য দেয়ার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। এটি সরকারের সিদ্ধান্ত, তবে আমরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কথা জানিয়েছি। সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রয়ের তখন সেটি আমরা করব। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে সরকারের নির্দেশনা মেনে ন্যায্য দামে টিসিবির পণ্য বিক্রি করেছি।’