দুদিনের সফরে ঢাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট: প্রাধান্য পাবে স্যাটেলাইট, উড়োজাহাজ ও অস্ত্র বিক্রি

দুদিনের সফরে ঢাকায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট: প্রাধান্য পাবে স্যাটেলাইট, উড়োজাহাজ ও অস্ত্র বিক্রি

দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করবেন। তার সম্মানে প্রধানমন্ত্রী আয়োজিত ভোজসভায় যোগ দেবেন। দুই নেতা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর এবং একটি যৌথ প্রেসব্রিফিংয়ে অংশ নেবেন। ঢাকায় ফরাসি দূতাবাস তাদের ফেসবুক পাতায় বলেছে প্রেসিডেন্টের এই সফরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রকল্প এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বিষয়ক সমঝোতা চুক্তি
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ বাংলাদেশ সফরকালে মহাকাশে আরও একটি নতুন স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের চুক্তি সই হতে যাচ্ছে। ফ্রান্সের সহায়তায় এবার যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে তার নাম বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২। এটি একটি ‘আর্থ অবজারভেটরি’ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে পৃথিবী তথা বাংলাদেশের স্থলভাগ ও জলভাগ পর্যবেক্ষণ করা হবে। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়েছিলো ২০১৮ সালের ১৯শে মে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে। এটিও নির্মাণ করেছিলো ফরাসি একটি প্রযুক্তি কোম্পানি।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হওয়ায় সমুদ্র অঞ্চল বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সমুদ্র অঞ্চলে নজরদারি বাড়ানো সম্ভব হবে এই দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কেউ অনধিকার প্রবেশ কিংবা কোনো অপতৎপরতা চালাচ্ছে কি না সেটাও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানা যাবে।  

 ২০১২ সালে মিয়ানমারের সাথে বিরোধপূর্ণ ১ লক্ষ ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং ২০১৫ সালে ভারতের কাছ থেকে ১৯,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমা জয় করে বাংলাদেশ। কোনরকম যুদ্ধ ছাড়া, রক্তপাত ছাড়া শেখ হাসিনার দূরদর্শীতা এবং মস্তিষ্কপ্রসূত সুচিন্তার ফলাফল ছিল এই বিশাল সমুদ্রসীমা বিজয়। এবার সমুদ্রে নিজেদের নজরদারি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফ্রান্সের সাথে এই সমঝোতা চুক্তি সই করবে সরকার।
 
এয়ারবাস থেকে উড়োজাহাজ কেনা 
চলতি বছরের শুরুতে ফ্রান্সের এয়ারবাস কোম্পানি থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ।  তবে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং থেকেও নতুন উড়োজাহাজ কেনা অব্যাহত রাখার বিষয়েও চাপ আছে। আমেরিকান ভিসা নীতি বা স্যাংশানের মাঝেই মূলত এবছরের শুরুতে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো বাংলাদেশ।  এ বছরের ২২ মার্চ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ বহুজাতিক কোম্পানি এয়ারবাসের কাছ থেকে উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করছে।  তবে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় কতটি উড়োজাহাজ কেনা হবে, সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

এয়ারবাস পৃথিবীর অন্যতম বড় বিমান সংস্থা, যারা বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের নকশা, নির্মাণ ও বিপণন করে। এটি ইউরোপভিত্তিক এবং ফ্রান্স, ব্রিটেন ও স্পেনে তাদের বড় অফিস ও সংযোজন কারখানা রয়েছে। এয়ারবাসের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং, যাদের কাছ থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস কিছুদিন আগে বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ কিনেছে।

এয়ারবাস বাংলাদেশকে এভিয়েশন খাতে প্রযুক্তি বিনিময়ের পাশাপাশি শিক্ষা ও দক্ষতাবিষয়ক সহায়তাও দিতে চায়। এর মাধ্যমে ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এভিয়েশন খাত নিয়ে যোগাযোগ আরও গভীর হবে বলে তখন গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। 

সমরাস্ত্র বিক্রি
বাংলাদেশও ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের কাজ শুরু করেছে। ২০২০ সালের মার্চে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঢাকায় এসেছিলেন বাংলাদেশের কাছে রাফাল জঙ্গি বিমান বিক্রির প্রস্তাব তুলে ধরার জন্য। এরপর ২০২১ সালে শেখ হাসিনার ফ্রান্স সফরের সময়ে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সমঝোতা পত্রে স্বাক্ষর করেছিলো বাংলাদেশ ও ফ্রান্স।  দেশটি অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশে সমরাস্ত্র বিক্রি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে।  তাই এ বিষয়ে এবার কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

সাম্প্রতিক সময়ে আফ্রিকার দেশগুলোতে ফ্রান্সের উপনিবেশবাদী আধিপত্যের এক পতন পর্বের শুরু হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মহল ধারণা করছে। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের ঝুঁকিতে রয়েছে ফ্রান্স। তাই ফ্রান্সের দরকার নতুন ব্যবসায়িক গন্তব্য।  ফলে অনেকের ধারণা যে, জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো, এ অঞ্চলে বাণিজ্যের বিস্তার ঘটানো।  এব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “সমরাস্ত্র হোক আর এয়ারবাস হোক-তাদের মূল ফোকাসই থাকবে ব্যবসা। আর মনে রাখতে হবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলে ফ্রান্সের স্বতন্ত্র সামরিক উপস্থিতি আছে। অর্থাৎ এ অঞ্চলটি তাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণেই ফ্রান্স চাইবে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে।‘
 
ফ্রান্স বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রধানতম খেলোয়াড়দের একটি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফ্রান্স উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।  তাই চুক্তি যাই হোক, সর্বোচ্চ পর্যায়ের বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের এই সফর দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার নতুন নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করবে বলেই ধারণা করা যায়।
 
আবার বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তের এই সফর কূটনীতিতে বাংলাদেশ সরকারকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কারণ ফ্রান্সের কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব বৈশ্বিক বিষয়গুলোর গতিপথকে প্রভাবিত করে। তাই আগামী নির্বাচনে ইউরোপ ও পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সরকারের প্রতি নানামুখী যে চাপ রয়েছে তা প্রশমিত করার ভালো একটি উপলক্ষ্য হতে পারে এই সফর।