প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর

প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর

মঙ্গলবার ব্রাসেলস যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ওরসুলা ভন ডার লিয়েনের আমন্ত্রণে গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম সম্মেলনে অংশ নিতে তিন দিনের সফরে বেলজিয়াম যাচ্ছেন তিনি।

দেশে সাধারণ নির্বাচনের আগ মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনতিক, অর্থনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে দেশ বিরোধী বিভিন্ন মহল ও গোষ্ঠি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) যে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে, যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইইউ’র মধ্যে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে তার পরিবর্তন ঘটবে। ইইউ’র সঙ্গে বাংলাদেশের যে পাঁচ দশকের সম্পর্ক, সেটিকে তুলে ধরে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ইইউ নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে 

বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সফরের পর ব্রাসেলসে এ সফর রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এক বছরের বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অব্যাহতভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।

সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার দে ক্রো এবং লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার বেটেলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করনে।

রবিবার (২২ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রীর বেলজিয়াম সফর নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বিশ্বব্যাপী স্মার্ট, পরিবেশবান্ধব এবং নিরাপদ ডিজিটাল প্রযুক্তি, জ্বালানি, পরিবহন খাতে অবকাঠামো নির্মাণ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্লোবাল গেটওয়ে উদ্যোগের ঘোষণা দেয়। এ উদ্যোগের আওতায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সদস্য রাষ্ট্র ও অন্য অংশীদাররা অগ্রাধিকার খাতগুলোতে ২০২১-২০২৭ সালের মধ্যে মোট ৩০০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর একটি ঋণ সহায়তা চুক্তি সই হবে। এছাড়া, বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অনুদান হিসেবে প্রদানের জন্য ইউরোপিয়ান কমিশন এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর একটি চুক্তি এবং বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইউরোর একটি অনুদান চুক্তি সই হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এ চুক্তিটি বাংলাদেশে ব্যাংকটির অধিকতর বিনিয়োগের পথ প্রসারিত করবে বলে আশা করা যায়। এ সফরের সময় বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের মধ্যে বাংলাদেশের সামাজিক খাতে ৭০ মিলিয়ন ইউরোর পাঁচটি আলাদা অনুদান চুক্তি সই হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবেন।

শেখ হাসিনা ও ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ওরসুলা ভন ডার লিয়েনের মধ্যে বৈঠকের পাশাপাশি বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার দে ক্রো এবং লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার বেটেলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের ৫০ বছরের অংশীদারিত্ব নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার ঘোষণা দেবেন বলে আশা করা যায়।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ব্রাসেলস সফরে তিনটি বিষয় অগ্রাধিকার পাবে। এগুলো হলো ঋণ ও মঞ্জুরি হিসেবে প্রায় সাড়ে ৩৯ কোটি ইউরো পাওয়ার চুক্তির মাধ্যমে গ্লোবাল গেটওয়ে তহবিলে যুক্ততা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ রূপরেখা নিয়ে আলোচনা এবং ইইউভুক্ত কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা। 

ঢাকা ও ব্রাসেলসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে এসব কথা জানিয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচনের আগে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সফরের পর ব্রাসেলসে এ সফর রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এক বছরের বেশি সময়জুড়ে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি অব্যাহতভাবে আহ্বান জানিয়ে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাসেলসে ২৫ ও ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠকে অংশ নিতে আগামী মঙ্গলবার বেলজিয়াম যাচ্ছেন।

গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই প্রস্তাবেও ২০২৪ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাসেলসে ২৫ ও ২৬ অক্টোবর অনুষ্ঠেয় গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠকে অংশ নিতে আগামী মঙ্গলবার বেলজিয়াম যাচ্ছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত সপ্তাহে সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ইউরোপীয় কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল গেটওয়ে কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য ৩০ হাজার কোটি ইউরোর তহবিল বিনিয়োগের জন্য সাড়ে ১৩ হাজার কোটি ইউরো চূড়ান্ত করা হয়েছে।

ঋণ ৩৫ কোটি ইউরো, মঞ্জুরি সাড়ে ৪ কোটি
ইইউর ওয়েবসাইটে গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠকের প্রতিপাদ্য উল্লেখ করা হয়েছে ‘টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে একসঙ্গে শক্তিশালী হওয়া’। বৈঠকে ইইউ এবং জোটের অংশীদার আমন্ত্রিত কয়েকটি দেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি), সংস্কার এবং উন্নয়নবিষয়ক ইউরোপীয় ব্যাংক (ইবিআরডি), বেসরকারি খাত, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। আমন্ত্রিত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, সেনেগাল, নামিবিয়া, মলদোভাসহ ২০টি দেশের সরকারপ্রধানেরা বৈঠকে অংশ নেবেন।

ইউরোপীয় কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গ্লোবাল গেটওয়ে কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০২১ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত ছয় বছরের জন্য ৩০ হাজার কোটি ইউরোর তহবিল বিনিয়োগের জন্য সাড়ে ১৩ হাজার কোটি ইউরো চূড়ান্ত করা হয়েছে। গ্লোবাল গেটওয়ে কৌশলের মাধ্যমে ইউরোপের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন এবং সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা এবং নিরাপত্তা জোরদারের মতো বিষয়গুলোয় জোর দেওয়া হয়েছে।

গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। উদ্বোধনী অধিবেশনের আলোচনায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে উত্তরণ, শিক্ষা ও গবেষণা, গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল, যোগাযোগের করিডরের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। ২৬ অক্টোবর শেষ দিনের আলোচনায় স্বাস্থ্য পণ্য উৎপাদন এবং ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের বিষয়ে আলোচনা হবে। ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল সমাপনী উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তৃতা করবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফোরামের উদ্বোধনী অধিবেশন বক্তৃতা করতে পারেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, দুই দিনের এ আলোচনায় গ্লোবাল গেটওয়ের আওতায় ৮৯ প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে ঘোষণা দেওয়া হবে। বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদনে সহযোগিতায় জোর দিচ্ছে ইইউ। এরই অংশ হিসেবে ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক থেকে সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুতে বাংলাদেশকে ৩৫ কোটি ইউরো ঋণ এবং সাড়ে ৪ কোটি ইউরো মঞ্জুরি হিসেবে দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে। গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে এ বিষয়ে চুক্তি সই হবে।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্রাসেলসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উরসুলা ফন ডার লেইয়েন বৈঠকে ইইউ–ঢাকা সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তির পর এখন দুই পক্ষের সম্পর্কের উত্তরণ কোন পথে হতে পারে, সেটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
ইইউর সঙ্গে সম্পর্ক উত্তরণের আলোচনা

টানা তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটিই হতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউরোপীয় কমিশনের কোনো অনুষ্ঠানে প্রথম অংশগ্রহণ। তিনি ২০১০ ও ২০১৮ সালে অন্য ফোরামের বৈঠকে যোগ দিতে ব্রাসেলস সফর করেছিলেন।

ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ব্রাসেলসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে উরসুলা ফন ডার লেইয়েন বৈঠকে ইইউ–ঢাকা সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তির পর এখন দুই পক্ষের সম্পর্কের উত্তরণ কোন পথে হতে পারে, সেটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে। সম্পর্কের পরের ধাপে পারস্পরিক অংশীদারত্বকে উন্নয়ন সহযোগিতা থেকে কৌশলগত সহযোগিতায় উত্তরণ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।

ইউরোপের সঙ্গে সহযোগিতা বা অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে মানবাধিকার সুরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ইইউ সব সময় মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় ধারাবাহিক উন্নতির বিষয়টিতে জোর দেয়। ফলে সম্পর্কের পরের ধাপের ক্ষেত্রেও মানবাধিকার একটি অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে থাকবে।

ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে অংশগ্রহণকে কাজে লাগিয়ে ইইউভুক্ত দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় নির্বাচনসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ে নিজের অবস্থান তাঁদের কাছে সরাসরি তুলে ধরতে চেষ্টা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।