ব্যালটে ভোটের পরীক্ষা, কতটা প্রস্তুত ইসি?

ব্যালটে ভোটের পরীক্ষা, কতটা প্রস্তুত ইসি?

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়ার চিন্তা করছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু আর্থিক সংকটে সরকার অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট হবে ব্যালট পেপারে। যদিও বর্তমান ইসির অধীনে এ পর্যন্ত সংসদের উপনির্বাচনসহ সিটি করপোরশনের ভোট ইভিএমে হয়েছে। কিন্তু আগামী সোমবার (১৭ জুলাই) ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচনে ভোট নেওয়া হবে ব্যালট পেপারে। সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ করা নিয়ে অনেকটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি ইসি। সংস্থাটি এই নির্বাচনের ভোটের মাধ্যমে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণের সক্ষমতা দেখাতে চায় ইসি। পাশাপাশি ব্যালটেও সুষ্ঠু ভোটের নির্দশন রাখতে চায়।

অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে ভোট হওয়ায় তারাও দিনশেষে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়েছে। ইসির চাহিদার আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।

গত শুক্রবার উপনির্বাচনের প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের সাহসিকতার সঙ্গে নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দিয়ে নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছেন, সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করবেন। আমাদের দেশ, বহির্বিশ্ব, আন্তর্জাতিক বিশ্ব সবাই জানুক যে আমরা একটি সুন্দর নির্বাচন করতে পারি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভিএম ও ব্যালটে ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া পুরোপুরি আলাদা। তবে অনিয়মের ঝুঁকি বেশি ব্যালটে। কারণ ভোট ব্যালট ছিনতাই, জোর করে ভোট দেওয়ার অভিযোগ বহুদিনের। তাই অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান-বনানী ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকার এই ভোট যাতে সুষ্ঠু হয় সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে নির্বাচন কমিশন।

কারণ উপনির্বাচন নিয়ে ভোটার ও খোদ প্রার্থীদের মধ্যে খুব বেশি উৎসাহ উদ্দীপনা না থাকলেও আসনের সীমানার মধ্যে কূটনৈতিক জোন থাকায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো ভোট প্রমাণের চেষ্টা করতে হবে কমিশনকে। কারণ তাদেরও নজর থাকবে এই ভোটে।

বিশ্লেষকরাও বলছেন, উপনির্বাচন হলেও এটা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সক্রিয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে গ্রহণযোগ্যতা হারানোর আশঙ্কা আছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ভোট নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব আগ্রহ না থাকলেও যে সময়ে নির্বাচন হচ্ছে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মহলও সংসদ নির্বাচন নিয়ে সক্রিয়। অন্যদিকে ভোট হবে ব্যালটে। সব মিলিয়ে ভোট ছিনতাই ঠেকানো, ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা, সর্বোপরি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট উপহার দেওয়া অবশ্যই চ্যালেঞ্জ হবে ইসির জন্য।

এদিকে ভোটে অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকার কথা জানিয়ে ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ইসি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে প্রতি কেন্দ্রে ১৯ থেকে ২১ জনের ফোর্স মোতায়েনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। সাধারণ কেন্দ্রে বিভিন্ন বাহিনীর ১৯ জন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২১ জন সদস্য মোতায়েন থাকবে।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনায় নেওয়া সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান বিপিএএ ইতোমধ্যে পরিপত্রও জারি করেছেন।


বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানকে পাঠানো এ সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ১৭ জুলাই ঢাকা-১৭ নির্বাচনী এলাকার শূন্য আসনে নির্বাচন উপলক্ষে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ ভূমিকার ওপর সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান বহুলাংশে নির্ভর করছে। সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহ সততার সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করলেই সরকারের নিরপেক্ষতা জনগণের নিকট দৃশ্যমান হবে।

উপনির্বাচনে সোমবার সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়ে ভোটগ্রহণ চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ ওয়ার্ড এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৭ (১৯০) সংসদীয় আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫টি। ভোট কেন্দ্র ১২৪টি।এসব কেন্দ্রের মধ্যে ৬০৫টি ভোট কক্ষে ভোট নেওয়া হবে।

যেভাবে কেন্দ্রভিত্তিক কাজ করবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাধারণ কেন্দ্রে অস্ত্রসহ পুলিশ পাঁচ জন, আনসারের দুইজন সদস্য থাকবে। এছাড়া অস্ত্র ছাড়া লাঠি হাতে থাকবে আনসারের ১২ জন সদস্য। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে পুলিশের দুজন অতিরিক্ত সদস্য থাকবে।

আবার পুলিশের ১০টি মোবাইল টিম পাঁচটি মোবাইল স্ট্রাইকিং টিম, র‌্যাবের ছয় টিম ও ছয় প্লাটুন বিজিবি নিয়োজিত থাকবে ভোটের এলাকায়। নির্বাচনী অপরাধ আমলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত ও সংক্ষিপ্ত বিচার কাজ পরিচালনায় ১৫ জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ছয়জন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন।


এদিকে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ও যুব উন্নয়ন সংস্থার ২১ জন পর্যবেক্ষক ভোট দেখবেন বলে জানা গেছে।

কোন বাহিনী কি কাজ করবে

নির্বাচনি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পুলিশ বাহিনীর। ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান হবে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রধান কাজ। এছাড়া নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সকল সরঞ্জাম আনা নেওয়ায় নিরাপত্তা দেওয়া, নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তা দেওয়া, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলোর নিরাপত্তা দেওয়া। স্থানীয় জননিরাপত্তা, ভোটকেন্দ্রে ভোটারগণের সুশৃঙ্খল লাইন করানোসহ স্থানীয় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা, ভোটারগণের জন্য আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা।

বিজিবি/আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট/ রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশনা অনুসারে তারা কাজ করবেন। নির্বাচনি এলাকায় বিজিবি রিটার্নিং অফিসার সহায়তা চাইলে অন্য সংস্থাকে সহায়তা করবে। নির্বাচনের জন্য হুমকিস্বরূপ কোনো ব্যক্তি/বস্তুর যাতায়াত/চলাফেরা ইত্যাদি আইন অনুযায়ী রোধ করবে বিজিবি।

অন্যদিকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশনা অনুসারে র‍্যাব মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনি এলাকায় সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবে। সহায়তা চাইলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সহায়তা করবে। র‍্যাব প্রয়োজনে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারবে এবং চাদিহার প্রেক্ষিতে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে অথবা ভোট গণনা কক্ষের শান্তি-শৃঙ্খলায়ও কাজ করবে র‌্যাব।

অন্যদিকে আনসার ও ভিডিপির সদস্য পুলিশ বাহিনী কর্তৃক নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে। রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসারের চাহিদার প্রেক্ষিতে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে কিংবা ভোট গণনা কক্ষের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে দায়িত্ব পালন করবে।

দুই প্রার্থী ছাড়া কারও নামডাকই নেই

চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান ফারুক গত ১৫ মে মৃত্যুবরণ করায় আসনটি শূন্য হয়ে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন - আলোচিত ইউটিউবার মো. আশরাফুল হোসেন আলম (হিরো আলম), আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, জাতীয় পার্টির জিএম কাদেরপন্থী সিকদার আনিসুর রহমান, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. রেজাউল ইসলাম স্বপন, গণতন্ত্রী পার্টির মো. কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট'র মো. আকতার হোসেন ও তৃণমূল বিএনপি’র শেখ হাবিবুর রহমান।

তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও হিরো আলম ছাড়া কোনো প্রার্থীরই তেমন কোনো নামডাক ছিল না শুরু থেকে। প্রচার প্রচারণায়ও নেমেও অন্য প্রার্থীরা খুব একটা সাড়া ফেলতে পারেননি।

কী বলছে ইসি

কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ, নির্মোহ ও নির্লিপ্ত থেকে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে ইসি রাশেদা সুলতানা বলেছেন, আমরা চাই একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট। একটা কথা মনে রাখবেন—একটা খেলার মাঠ, মাঠে অনেক প্লেয়ার। যার যা দায়িত্ব তা পালন করতে হবে। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব। আপনারা আপনাদের দায়িত্ব পালন করবেন।

ভোটাররা যাতে এসে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে তাও নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন এই কমিশনার।

সৌজন্য- ঢাকা মেইল