শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে কলিজা লাগে
নিজামুল হক বিপুল
ফিলিস্তিনের গাজা এখন অবরুদ্ধ। সকল মানবিকতা উবে গেছে। মুহুর্মুহু বোমা হামলা আর গুলির নিচে আটকা পড়েছে লাখ লাখ জীবন। নারী,পুরুষ, শিশু কেউ বাদ যাচ্ছে না। মানবতা সেখানে ডুকরে কাঁদছে। বেঁচে থাকার জন্য লাখ লাখ মানুষ ছুটছেন দ্বিগবিদ্বিগ। কেউ বা আশ্রয় নিচ্ছেন হাসপাতালে, কেউবা প্রাণপণে ছুটছেন সীমান্তের দিকে। কোনোভাবে একটু আশ্রয় চান। দেশ ছেড়েও যদি প্রাণটা বাঁচানো যায়।
কিন্তু কে শোনে কার কার কথা। বোমার শব্দে মানবিকতার সেই আর্তচিৎকার যাচ্ছে না হামলাকারী গোষ্ঠির কানে। বরং হাসপাতালে আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থেকেও প্রাণ বাঁচাতে পারছেন না ফিলিস্তিনি সাধারণ নাগরিকরা। ইসরাইলের ভয়ঙ্কর বোমা আঁছড়ে পড়ছে নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর। মঙ্গলবার (১৭অক্টোবর) তো গাজার আল আহলি আরব হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৫০০ জন নিহত হয়েছেন। আরো অনেকেই হাসপাতালের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েন। অথচ ওই হাসপাতালটিতে ইসরায়েলের হামলায় আহতসহ শত শত রোগী ভর্তি ছিলেন। এ ছাড়া জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরাও এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলা ফিলিস্তিনের সর্বহারা মানুষগুলো জড়ো হয়েছেন মিশরের সিনাই উপত্যকার রাফাহ সীমান্তে। অথচ সেই সীমান্ত এখনও বন্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা সীমান্ত খুলে দেওয়ার আহ্বান জানালেও সেটি খুলে দেওয়া হয়নি আজও।
ফিলিস্তিনের মানুষের আহাজারি, আর্তনাদ আর প্রাণ বাাঁচানোর লড়াই দেখে মনে পড়ছে আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের কথা। ওই সময়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ মায়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে নির্বিচারে রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশুকে হত্যা আর গ্রামকে গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার কথা। সেদিনের সেই বর্বর হামলায় বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ঢল নেমেছিল নাফ নদীতে। নিজ দেশে নিজেদের শাসকগোষ্ঠির প্রত্যক্ষ হামলায় সেদিন সর্বস্বান্ত রোহিঙ্গাদের সবাই তাকিয়ে ছিলো বাংলাদেশের দিকে। বাংলাদেশ সরকারের দিকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। শুধু রোহিঙ্গারা নয়, গোটা বিশ্ব তাকিয়েছিলো শেখ হাসিনার দিকে।
সবার সব দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে সেদিন বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুহুর্তেই সীমান্তের জিরো লাইনে অপেক্ষমান লাখ লাখ রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ শিশুদের ঢল নামে নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফের দিকে।
টানা কয়েকদিন রোহিঙ্গারা যে যেভাবে পারে বাংলাদেশে পা রেখে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। সেদিনের ঘটনা ছিলো বিরল। বিশ্বের খুব কম দেশই এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের সীমান্ত খুলে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারে।
মনে আছে, ২০১৫ সালের কথা। ওই বছরের গ্রীষ্মে জার্মানির সীমান্ত খুলে দিয়ে ১০ লাখেরও বেশি শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীকে সে দেশে ঢুকতে দিয়েছিলেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গোলা মার্কেল। ইউরোপের অন্যরা এত অভিবাসীর আগমন দেখে ক্ষিপ্ত হলেও মার্কেল ছিলেন উদার। অথচ ইইউ ২০১২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল, কিন্তু তার মাত্র তিন বছর পরই এর সদস্য দেশগুলো সিরিয়াসহ নানা দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের ঠেকাতে তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিতে থাকে। তখনই ঘুরে দাঁড়ান জার্মান চ্যান্সেলর।
কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিলো বাংলাদেশ,বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যা তার মানবিকতার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। অন্যথায় সেদিন টেকনাফ সীমান্ত খুলে না দিলে হয়তো লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরনার্থীকে সীমান্তের জিরো লাইনে অপেক্ষায় থেকেই প্রাণ বাঁচানোর লড়াই করতে হতো। হয়তো কত শত প্রাণ অকালেই ঝরে যেতো।
আজকে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ বাঁচানোর যে হাহাকার চলছে, তাদের সেই হাহাকার যেনো কারো মন গলাতে পারছে না। হৃদয়ে দাগ কাটছে না। গাজা থেকে বের হবার তিনটি সীমান্ত পথ রয়েছে। এরমধ্যে দুটি সীমান্তপথ পুরোপুরি ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে এবং সেই দুটোই এখন বন্ধ।
এখন গাজা থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে মিশরের সিনাই উপত্যকার রাফাহ ক্রসিং। যেটি গাজার সর্বদক্ষিণের সীমান্ত। কিন্তু মিশর সেটি বন্ধ রেখেছে। যদিও গাজায় ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর জন্য মিশর শেষ পর্যন্ত রাফাহ ক্রসিং খুলে দিতে সম্মত হয়েছে। এই ক্রসিং দিয়ে ২০টি পর্যন্ত ত্রাণবাহী ট্রাক পাঠানো যাবে।
ত্রাণ পাঠানোর জন্য মিশর সিনাই উপত্যকার একমাত্র সীমান্ত দরজাটি খুলে দিলেও ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে কোনো রকম পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ এই করিডোর দিয়ে কোনো ফিলিস্তিনি মিশরে প্রবেশ করার কোনো সুযোগ নেই।
এই যে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটোছুটি, আর্তনাদ, হাহাকার- সেখানে মানবিকতার মৃত্যু হয়েছে। মানবাধিকার সেখানে ভুলন্টিত। রক্ত গঙ্গা বয়ে গেলেও বিশ্ব মোড়লদের কাছে এটা যেন আনন্দের বিষয়!
একটা বিষয় পরিস্কার যুদ্ধ বিধ্বস্ত জনপদের শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য সীমান্ত দরজা খুলে দিতে হলে মানবিক নেতা হতে হয়। কলিজা লাগে, কলিজা। সাহস লাগে। ঝুঁকি নেওয়ার সাহস লাগে। যেটা ২০১৫ সালে দেখিয়েছিলেন তৎকালীন জার্মান চ্যান্সেল অ্যাঙ্গোলা মার্কেল কিংবা ২০১৭ সালে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেই দেশের সরকারের রোষানলের শিকার হয়ে আসা মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ইতিহাসে তারা মানবিক নেতা হয়েই থাকবেন।
আজকে ফিলিস্তিনের দিকে তাকালে শুধু অ্যাঙ্গোলা মার্কেল বা শেখ হাসিনার মত নেতার কথাই মনে পড়ছে। আক্ষেপ ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার লাখ লাখ আশ্রয়প্রার্থীদের সামনে এরকম একজন নেতা নেই। যিনি দ্বার খুলে দিবেন।
লেখক-সাংবাদিক