শাবির উপাচার্যের ‘সম্মানবোধ’ জাগ্রত হবে: আনু মুহাম্মদ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ‘সম্মানবোধ’ জাগ্রত হলে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। ফরিদ উদ্দিন আহমেদের উদ্দেশে এই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেছেন, ‘নিজের সম্মানবোধ থাকলে অন্যদের সম্মান করতে শিখুন। পদত্যাগ করলে আপনার সম্মানটা থাকবে।’
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত এক সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে আনু মুহাম্মদ এসব কথা বলেন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অপসারণ, হামলাকারী পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিচার, শিক্ষার্থীদের নামে হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের সমর্থনে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো এই সমাবেশের আয়োজন করে।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদের উদ্দেশে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘যত ক্ষমতা ধরে রাখবেন, ভুল চেয়ারটি যত দিন আঁকড়ে ধরে জোর করে বসে থাকবেন, তত আপনার সম্মানহানি হবে। আশা করি, আপনার মধ্যে সেই সম্মানবোধ জাগ্রত হবে৷’ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘ফরিদ উদ্দিনের এই অবস্থা দেখে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও বার্তা নেবেন। সরকারের প্রতি আহ্বান ও দাবি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করার নীতি ও রীতি থেকে সরে আসুন।’
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সব মানুষেরই আন্দোলন বলে মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি খুবই ন্যূনতম। এর প্রতি দেশের সব নাগরিকের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে আমি সংহতি জানাই। কারা বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন, এই আন্দোলনের কারণে তা উন্মোচিত হয়েছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সংগঠন উপাচার্য পরিষদ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এর মাধ্যমে কারা এ ধরনের অপরাধ, শিক্ষার্থীবিরোধী-নারীবিরোধী ও শ্রেণিবিদ্বেষী চিন্তাভাবনা ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দখল করে আছেন, তা–ও উন্মোচিত হয়েছে। এই সমর্থনের মধ্য দিয়ে তাঁরা নিজেদের চেহারা উন্মোচিত করেছেন যে তাঁরাও একই অপরাধে অপরাধী।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার বরাত দিয়ে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, বাইরে খাওয়ার সামর্থ্য না থাকায় যেসব শিক্ষার্থী হলে খান, তাঁদের ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে। এ অবস্থার মধ্যে দিন যাপন করা শিক্ষার্থীদের মেধা কীভাবে বিকশিত হবে? শিক্ষার্থীরা কী খেলো না খেলো, তাতে প্রশাসনের কিছু যায়–আসে না। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের নীতিই সরকারের নীতি। সেটি হলো শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য কোনো ভর্তুকি দেওয়া যাবে না। হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নেই। সরকারি ছাত্রসংগঠন হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। গণরুমে থাকা নবীন শিক্ষার্থীদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। নির্যাতন করা হয়, যাতে কখনোই তাঁরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে না পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যরা আসলে নির্বাচিত নন, নিয়োগপ্রাপ্ত। এই দুয়ের তফাতের কারণেই আজকের অবস্থা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সুষম খাদ্য না দিয়ে, তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আমরা কীভাবে গড়ে তুলব? তাঁদের প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা দেশের পুরো রাজনৈতিক অবস্থার একটা প্রতিফলন।
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, উপাচার্যের পদে থাকার নৈতিক অধিকার ফরিদ উদ্দিন আহমেদের নেই। সামান্য লজ্জা থাকলে তিনি পদত্যাগ করতেন। তাঁর কোনো লজ্জাবোধ নেই। তাঁকে বলব, আপনি উপাচার্য পদ ছেড়ে দিন।’ ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সরকারের উদ্দেশে এই চিকিৎসক বলেন, ‘ছাত্রদের কথা শুনুন, নইলে আপনাদের তখতে তাউস কেঁপে যাবে।’
সংহতি সমাবেশে অংশ নিয়ে ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবি করেন সাংবাদিক ও সাবেক ছাত্রনেতা ফারুক ওয়াসিফ। তিনি বলেন, ‘ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নিজেকে উপাচার্য মনে করেন না, মনে করেন জমিদার৷ আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জমিদারি স্টাইলে চালানো হয়। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাস দমনের নামে সাউন্ড গ্রেনেড প্রবর্তন করা হচ্ছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গ্রেনেড মারা উপাচার্য। এমন একজন পুতুল লোক উপাচার্য, প্রশাসক বা শিক্ষক পদে থাকতে পারেন, তার কারণ আমরা এই মডেলটা মেনে নিয়েছি।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা বলেন, ‘আমাদের টাকায় চলা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সন্তানেরা খেতে পায় না, উপাচার্য-প্রক্টররা লাখো-কোটি টাকার দুর্নীতি করেন। সুষম খাদ্য, পরিচ্ছন্ন ডাইনিংয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের কেন আন্দোলন করতে হবে? পাকিস্তানি মতাদর্শে রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ভয়ে ছাত্রদের গলা টিপে ধরা হচ্ছে।
ছাত্র ফেডারেশনের একাংশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাহিদ সুজন বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিচার করতে হবে৷
ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি অনিক রায় বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মেরুদণ্ড বিকিয়ে দিয়েই উপাচার্য হয়েছেন। বর্তমানে দেশ চালানো হচ্ছে পাকিস্তানি কায়দায়। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে ডাক দিয়েছে, তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এর সামনে সরকারকে মাথা নত করতে হবে।