সরকারের ধারাবাহিকতায় আলোকিত দেশ
বিপুল মাহমুদ ||
আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বিস্তৃীর্ণ জনপদ সন্ধ্যার পর ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হতো। সন্ধ্যার পর পরই নেমে আসতো রাতের গভীরতা। মানুষজন পরের দিনের সূর্যের আলোর দেখার অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়তেন।
গ্রামেগঞ্জে কিছু কিছু বাড়িঘরে কূপি বাতি কিংবা লণ্ঠনের আলো নিভু নিভু জ্বলত। কারণ ওইসব বাড়িতে শিশুরা পড়ালেখা করতো। বিদ্যুৎ এর আলো গ্রামের গঞ্জের মানুষের একটা বিস্ময় জাগানিয়া বিষয় ছিলো। দূরের গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছবে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি এদেশের মানুষ। তাদের কাছে বিদ্যুৎ মানে জেলা বা উপজেলা সদরের সরকারি অফিস-আদালত আর্থিকভাবে অবস্থা সম্পন্ন বাড়িতে বাতি জ্বলা। এতেই তাদের আনন্দ। দুর্গম জনপদে বিদ্যুৎ বাতি জ্বলবে এটা তাদের ভাবনায় ছিলো না কখনোই। দূরের গ্রাম থেকেই শহরের লাল-নীল বাতি দেখওতেই তারা অভ্যস্ত ছিল।
স্বাধীনতার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এমন অন্ধকারই ছিলো বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রাম, জনপদ। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল বিএনপি। এই সময়ে তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেমন মনোযোগ দেয়নি। তাদের ওই সময়ের শাসনামলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দলটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর নানা প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে প্রায় ২১ বছর পর জনগণের রায়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। এই সময়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশকে এগিয়ে নিতে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এরমধ্যে অন্যতম ছিল দেশের মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোরজগতে নিয়ে আসা। সে লক্ষ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দেয়। মাত্র পাঁচ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৮০৩ মেগাওয়াট।
কিন্তু সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকায় ওই সময়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল সেই ধারাবাহিকতাতেও ছেদ পড়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই। ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদে বিএনপির পাঁচ বছরের শাসনামলে বিদ্যুৎখাতে আবারও পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করে বাংলাদেশ। পরিসংখ্যান বলছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের এই মেয়াদে দেশে বিদ্যুৎ এর উৎপাদন হয়েছে তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার যে তিন হাজার ৮০২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উপাদন করে গিয়েছিলো সেখান থেকে কমেছে আরও ৫৩৪ মেগাওয়াট।
অথচ, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়লে সাধারণ মানুষকে বিদ্যুৎ এর খাম্বা দেখিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছে হাওয়া ভবন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান হাওয়া ভবনে বসে বিকল্প সরকার পরিচালনা করতেন। সেখানে বসেই তিনি বন্ধু মামুনকে সঙ্গে নিয়ে খাম্বা ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। যার ফলে ওই সময়টায় মানুষ বিদ্যুৎ পায়নি। শুধু খাম্বাই দেখতে পেয়েছে। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ায় বাংলাদেশের জনপদের পর জনপদ আবারো অন্ধকার যুগে প্রবেশ করে। আওয়ামী লীগ আমলে বিদ্যুৎ উপাদনের ফলে যেসব জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছেছিল সেগুলোও অন্ধকার হয়ে যায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে। আর শিল্পকারখানা তো গড়ে উঠার সুযোগই পায়নি শুধুমাত্র বিদ্যুৎ এর অভাবে।
জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের গতি অনেকটাই হ্রাস পায়। সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও দাতা সংস্থাগুলো থেকে বিনিয়োগের অভাবে ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয় মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এ সময় প্রতি বছর সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের মতো। ২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে সারাদেশের লোডশেডিং এর পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট। ২০০৬ সালের মে মাসে এসে সেই লোডশেডিং এর পরিমাণ ১০০০ মেগাওয়াট অতিক্রম করে। আর এই সময় সান্ধ্যকালীন বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ৪২০০ মেগাওয়াট। সরকারি কর্মকর্তাদের মতে এই লোডশেডিং এর পরিমাণ পরবর্তী বছর নাগাদ ১ হাজার ৬২৪ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যায়।
জোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এতোটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে, ওই সময় বিদ্যুতের দাবিতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বড় আন্দোলন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন স্থানীয় রাজনীতিক। একই সময় রাজধানীর শনির আখড়ায় হাজার হাজার এলাকাবাসী বিদ্যুৎ ও পানির দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন। আন্দোলন গড়ে তুলেন। বিদ্যুৎ নিয়ে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলের এসব ঘটনা এখনও দেশের মানুষ ভোলেনি।
২০০৯ সালের পটপরিবর্তনে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠা দিয়ে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় গিয়েই সবার আগে বিদ্যুৎখাতের উন্নয়নে মনযোগ দেয়। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে হলে এর বিকল্পও ছিলো না সরকারের কাছে। কারণ বিদ্যুৎ না হলে যেমন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে না, তেমনি অর্থনীতির চাকাও দ্রুত ঘুরবে না। তাই সরকার শুরুতেই ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেয়। কুইক রেন্টার এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত প্রথম দুই-তিন বছরে বিদ্যুৎখাতে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এসে দাঁড়ায় ৪৯৪২ মেগাওয়াট আর প্রকৃত সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৩২৬৮ মেগাওয়াট। ২০১০ ও ২০১১ সালে দৈনিক সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১৭৪ মেগাওয়াট ও ৪৬৯৮.৫ মেগাওয়াট। ২০১১ সালের জুন মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪,৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৬০০ মেগাওয়াট। অবশিষ্ট ২০০০ মেগাওয়াট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে উৎপাদিত। ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৮০০৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। ২০১২ সালের ২২ মার্চ পিডিবি রেকর্ড ৬০৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এসে দেশে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ১৭৯। ২৭ মে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ প্রকৃত সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৭১ মেগাওয়াট।
সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের ১৩ সেপ্টেম্বর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ ২৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র চার হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। আর চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ সেপ্টেম্বর দেশে দিনের বেলা বিদ্যুৎ এর চাহিদা হচ্ছে ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট এবং সন্ধ্যায় ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ১৫ সেপ্টম্বর এই চাহিদা ছিল যথাক্রমে ১১ হাজার ৪৫৫ মেগাওয়াট এবং ১৩ হাজার ৯২৬ মেগাওয়াট। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল ২৭টি। আর বর্তমানে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫১টিতে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ এর উৎপাদন দ্রুত বেড়ে চলছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিতে বিদ্যুৎ কোনো বিকল্প নেই। এবিষয়টি অনুধাবন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশে বিদ্যুৎ এর উৎপাদন দিনকে দিন বাড়িয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, পেকুয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মহেশখালী বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, উত্তরবঙ্গ সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুরের যৌথ উদ্যোগে ৭০০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জি টু জি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিউবো সিএইচডিএইচকে, চায়না জয়েন্ট ভেঞ্চার এবং মুন্সীগঞ্জে গজারিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে অনেকগুলো কেন্দ্র থেকেই এরইমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিট শিগগির উৎপাদনে আসবে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। আর ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি গ্রামকে বিদ্যুৎ এর আলোয় আলোকিত করতে সরকার সব রকম তৎপরতা চালিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। যার ফলে ইতিমধ্যে দেশের শতভাগ গ্রাম বিদ্যুৎয়াতি হয়েছে।
এখন আর বিদ্যুৎ এর অভাবে শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকছে না। কিংবা প্রচণ্ড গরমের মধ্যেও লোডশেডিং নেই। আগে যেভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষ বিদ্যুৎবিহীন থাকতেন, এখন সেটি আর দেখা যায় না। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে। সরকারের ধারবাহিকতা না থাকলে দেশে যেভাবে বিদ্যুৎ এর উৎপাদন হয়েছে সেটি বন্ধ হয়ে যেতো।