নতুন সেতু দিয়ে মানুষের কাছে যাচ্ছে উন্নয়নের ফল
গাজী মাসুদ
নদী বিধৌত বাংলাদেশে একসময় ছিল দুর্ভোগের আরেক নাম। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে বদলে গেছে সড়ক যোগাযোগ। এই উন্নয়ন আরও কার্যকর করেছে বিভিন্ন স্থানে চাহিদা অনুযায়ী ছোট-বড় মিলিয়ে বহু সেতু। এরমধ্যে প্রমত্তা পদ্মার উপর নিজের টাকায় ‘পদ্মা সেতু’ নির্মাণ হয়েছে। সবচেয়ে বড় এই সাফল্যের তালিকায় যুক্ত হয়েছে কমপক্ষে তিনশ নতুন সেতু।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সেতু বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। এ দুই বিভাগই প্রয়োজন ও যোগ্যতা অনুযায়ী বিভিন্ন সেতু তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ করে। এরমধ্যে সেতু বিভাগের অধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে ‘বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৬’ অনুযায়ী ১৫০০ মিটার বা তদূর্দ্ধ সেতু বাস্তবায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ, টোল সড়ক, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, টানেল, কজওয়ে, রিং রোড ইত্যাদি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বাকি সেতুগুলো সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে।
একসাথে শত সেতু
নিজস্ব অর্থায়নে দেশের ২৫টি জেলায় নবনির্মিত ১০০টি সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এসব সেতুর উদ্বোধন করেন তিনি। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক সেতুগুলো নির্মিত হয়। প্রায় ৮৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেতুর মধ্যে সবচেয়ে বড় সেতু সুনামগঞ্জের রানীগঞ্জ ইউনিয়নে, এর দৈর্ঘ্য ৭০২ মিটার। বাকি সেতুগুলোর মধ্যে ৮টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১০১ মিটার করে, ২০টি সেতুর দৈর্ঘ্য ৫১ থেকে ১০০ মিটার এবং ৭২টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ থেকে ৫০ মিটার।
এ ১০০টি সেতুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সেতু খাগড়াছড়িতে। এখানে মোট ৪২টি সেতু নির্মাণ করা হয়। এরপরের অবস্থানে রয়েছে সুনামগঞ্জ, এখানে মোট ১৭টি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর জেলায় ৪টি করে সেতু; রাজবাড়ী ও নেত্রকোনা জেলায় ৩টি করে; মানিকগঞ্জ, শেরপুর, পটুয়াখালী, বগুড়া ও চট্টগ্রাম জেলায় ২টি করে সেতু উদ্বোধন করা হয়।এছাড়া এর বাইরে মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, নাটোর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নোয়াখালী ও বান্দরবান জেলায় একটি করে সেতু উদ্বোধন করা হয়।
একসাথে ১৫০ সেতু
২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর দেশের ৮টি বিভাগের ৩৯টি জেলায় নবনির্মিত ১৫০টি সেতু ও ১৪টি ওভারপাস উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন হওয়া ১৫০টি সেতুর মধ্যে ৪০টি ময়মনসিংহ বিভাগ, ঢাকায় ৩২টি, চট্টগ্রামে ২৭টি, রাজশাহীতে ২২, খুলনায় ১২টি, বরিশাল ও রংপুরে ৮টি করে এবং সিলেটে একটি সেতু। একই সঙ্গে তিনি মহাসড়কের ওপর নির্মিত ১৪টি ওভারপাস উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে আটটি রাজশাহী বিভাগে এবং ছয়টি রংপুরে।
একই অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর কেওয়াটখালি সেতু এবং রহমতপুর সেতু নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।দেশের দীর্ঘতম স্টিল আর্চ সেতু কেওয়াটখালি সেতু নির্মাণে খরচ হবে মোট ৩ হাজার ২৬৩ কোটি ৬৩ লাখ টাকা এবং রহমতপুর সেতু নির্মাণে খরচ হবে ৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের জুনে সেতু দুটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
২য় কাঁচপুর, মেঘনা, গোমতী সেতু
গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দ্বিতীয় মেঘনা সেতু ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সালের ২৫ মে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সেতু দুটির উদ্বোধন করেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে গোমতী নদীর ওপর নির্মিত দ্বিতীয় গোমতী সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪১০ মিটার এবং মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীর ওপর দ্বিতীয় মেঘনা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯৩০ মিটার।
এর আগে, গত ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর নির্মিত একই প্রকল্পের আরেকটি সেতু- দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতুর উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। প্রকল্প সূত্র জানায়, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওবায়শি করপোরেশন, শিমঝু করপোরেশন, জেএফএফ করপোরেশন ও আইএইচআই ইনফ্রা সিস্টেমস কোম্পানি লিমিটেড ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেঘনা ও গোমতীর সঙ্গে দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে।
পায়রা সেতু
২৫ অক্টোবর ২০২১, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের একটি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এ স্বপ্ন পূরণ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এ সেতুর উদ্বোধন করেছেন। উদ্বোধনের পরপরই সেতুটি সব ধরনের যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে অবসান হলো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের পায়রা নদী পারাপারের দুর্ভোগ। ১ হাজার ৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত চার লেন পায়রা সেতুর দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৪৭০ মিটার, প্রস্থ ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার। ২০০ মিটার করে দেশের দীর্ঘতম দুটি স্প্যান বসানো হয়েছে পায়রা সেতুতে। নদীর তলদেশে বসানো হয়েছে ১৩০ মিটার দীর্ঘ পাইল।
বেকুটিয়া সেতু
পিরোজপুরের কঁচা নদীতে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, সকাল ১১টায় সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে উদ্বোধন ঘোষণা করেন। আগে সেতুটির নাম ছিল বেকুটিয়া ব্রিজ। পরবর্তীতে সেতুটির নামকরণ করা হয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ৮ম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। এ সেতুটির মাধ্যমে রাজধানী থেকে বেনাপোল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়। এর মাধ্যমে পিরোজপুর-খুলনা যোগাযোগে ফেরি যুগের অবসান হয়।
মধুমতি ও তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু
দেশের প্রথম ছয় লেনের মধুমতি সেতু এবং নারায়ণগঞ্জে তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর দুপুরে নিজ কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এই সেতু দু’টি উদ্বোধন করেন তিনি। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধুমতি নদীর উপর ৬৯০ মিটার দীর্ঘ মধুমতি সেতু নির্মিত হয়েছে যা স্থানীয়ভাবে কালনা সেতু নামে পরিচিত। ২৭.১ মিটার চওড়া সেতুটিতে চারটি উচ্চগতির লেন ৪.৩০ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড এবং দুটি সার্ভিস লেনসহ ছয়টি লেন রয়েছে।
অপরদিকে, তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতুটি বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম নাসিম ওসমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। এটি নারায়ণগঞ্জ শহরকে বন্দর উপজেলার সাথে সংযুক্ত করবে, অর্থনীতি চাঙ্গা করবে, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলার মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করবে। সেতুর প্রকল্প পরিচালক শোয়েব আহমেদ বাসসকে বলেন, ১.২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলগামী যানবাহন এবং একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলগামী যানবাহন যানজট এড়াতে এবং সময় বাঁচাতে নারায়ণগঞ্জ শহরকে বাইপাস করতে সক্ষম করবে।
আড়িয়াল খাঁ সেতু
মাদারীপুর সদর উপজেলার কাজীরটেক নামক স্থানে আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর প্রায় ৭০০ মিটার দীর্ঘ সপ্তম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুটি নির্মাণ করা হয়। চীনের আনহুই কন্সট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ ২০১৩ সালের মার্চে এর নির্মাণকাজ শুরু করে। এর সঙ্গে আরো চারটি ছোট সেতু ও সাড়ে চার কিলোমিটার দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ সড়ক নির্মাণ করা হয়।
চেঙ্গী সেতু
২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি স্বপ্নের চেঙ্গী সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাঙামাটির নানিয়াচর উপজেলার চেঙ্গী নদীর ওপর সেনাবাহিনীর ১৯ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন (ইসিবি) ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে। ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ দশমিক ২ মিটার প্রস্থের এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২০ কোটি টাকা।
রাঙামাটি থেকে বাঘাইছড়িতে সড়ক পথে যেতে পাড়ি দিতে হতো প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ। রাঙামাটি থেকে সড়কপথে লংগদু যেতেও প্রায় ১৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। সময়টাও লাগতো পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। এই উপজেলাগুলোর সঙ্গে রাঙামাটি সদরের কোনো বাস সার্ভিস চালু ছিল না। নৌ-পথেই একমাত্র ভরসা। কিন্তু নানিয়ারচরের চেঙ্গী সেতুর মাধ্যমে সেই দুর্গম পরিস্থিতি অনেকটাই লাঘব হয়।
আরও সেতু নির্মাণাধীন
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নির্মাণাধীন দ্বিতীয় তিস্তা সেতু। সৌদি সরকারের অর্থায়নে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর খেয়াঘাট এলাকায় ১ হাজার ৪৯০ মিটার (প্রায় দেড় কিলোমিটার) দীর্ঘ ও ৯.৬ মিটার প্রস্থ এই সেতুটির নির্মাণ কাজের দায়িত্ব পেয়েছে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। কচুয়া-বেতাগী-পটুয়াখালী-লোহালিয়া-কালাইয়া সড়কে পায়রা নদীর উপর সেতু নির্মাণ, দৈর্ঘ ১.৬৯ কি.মি। বরিশাল-ভোলা সড়কে কালাবদর ও তেতুলিয়া নদীর উপর সেতু নির্মাণ, দৈর্ঘ্য ১০.৪৯ কি.মি.।
রহমতপুর-বাবুগঞ্জ-মুলাদি-হিজলা সড়কে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর সেতু নির্মাণ, দৈর্ঘ্য ১.৫৯ কি.মি.। বাকেরগঞ্জ-বাউফল সড়কে কারখানা নদীর উপর সেতু নির্মাণ, দৈর্ঘ্য ১.৮৮ কি.মি.। এছাড়াও আরও বেশকিছু সেতু নির্মাণাধীণ অথবা প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে। শুধু মেগা প্রকল্প নয়। ছোট-মাঝারি-বড় সহ বহু সেতু নির্মাণের মাধ্যমে বর্তমান সরকার দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। এর মাধ্যমে যেমন যোগাযোগ সহজ হয়েছে, তেমনই অর্থনীতিতে এসেছে নতুন গতি।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।