বিএনপি হাইকমান্ডের সঙ্গে বিরোধে বহু নেতা নিষ্ক্রিয়
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপিতে দলীয় কোন্দল তীব্র হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের বহু নেতা নির্বাচন অংশ নেওয়ায় বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও হতাশ। এর বাইরে প্রভাবশালী অনেক নেতা নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। দলের বর্তমান আন্দোলন কৌশল নিয়েও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর নাখোস মাঠের কর্মীরা।
নির্বাচন কমিশন দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিএনপির অন্তত ৫২ জন নেতা দল থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন অংশ নিয়েছেন। যাদের বেশির ভাগই সাবেক সংসদ সদস্য। এর বাইরে স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি অনেক নেতা এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এতে দলের ভিতরে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিএনপি যেসব কেন্দ্রীয় নেতা নির্বাচনে গিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। যিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই শাহজাহান ওমর এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন ঝালকাঠি-১ আসন থেকে। একইভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর বিএনপি থেকে বের হয়ে করে বিএনএম এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন এবং ফরিদপুর-১ আসন থেকে নির্বাচন করছেন। বিএনপির আরেক সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও এক সময়ের দলীয় কূটনৈতিক সেলের প্রধান শমসের মবিন চৌধুরী তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনিও আগামী নির্বাচনে সিলেট-৬ আসন থেকে তৃণমূল বিএনপির দলীয় প্রতীক সোনালি আঁশ নির্বাচন করছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের আরেক উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে। বিএনপি চেয়ারপারসনের অপর উপদেষ্টা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মনজুর আলম চট্টগ্রাম-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার সম্প্রতি তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
এরকম আরও বেশ কয়েকজন প্রভাশালী নেতা এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এর বাইরে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের বহু নেতা নির্বাচন করছেন।
অপরদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখথরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমানউল্লাহ আমান, আমী খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলের শীর্ষ নেতাদের পএকটা বড় অংশ বিভিন্ন মামলায় কারাগারে বন্দী আছেন। মাঠ পর্যায়েও বহু নেতা মামলার কারণে দল থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এসব কারণে দলের মধ্যে যেমন নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিয়েছে, তেমনি বহু নেতা দল ছেড়ে নির্বাচন অংশ নেওয়ায় বিএনপির অবস্থা ছন্নছাড়া।
দলের হাই কমান্ডের সাথে বিশেষ করে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, ধ্বংসাত্বক আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে দলের শীর্ষ নেতাদের মতবিরোধ দেখা দেওয়ায় দীর্ঘদিন দলের ভিতরে নানারকম অস্থিরতা চলে আসছে। যার ফলে দলীয় নেতাদের সমন্বয়হীনতা, নেতাদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। ফলে দলের ভিতরে নেতাদের মধ্যে গ্রুপ, উপ-গ্রুপ তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে শান্তির্পূর্ণ আন্দোলন ছেড়ে সহিংস আন্দোলনের পথে যাওয়াটাকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বেশিরভাগ মেনে নিতে পারেননি। ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশ ঘিরে যে সহিংস তাণ্ডব বিএনপি নেতাকর্মীরা চালিয়েছিলেন তার নেপথ্যে লন্ডনে অবস্থানরত দলের হাইকমান্ডকে দায়ি করছেন দলীয় নেতারা। যদিও কেউই প্রকাশে দলীয় হাইকমান্ডের বিরুদ্ধে কথা বলতে চাননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, গত এক বছর ধরে বিএনপির নেতৃত্ব যেভাবে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে একটা পরিবেশ তৈরি করেছেন, সেখানে ২৮ অক্টোবরের ঘটনা বিএনপিকে আরও অন্তত ১০ বছর পিছনে টেলে দিয়েছে। ওই নেতারা বলেন, ‘সহিংসতার কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও দলকে দলীয় হাইকমান্ডের কারণে সেদিনের সহিংসতার পর দলের অধিকাংশ নেতা বিভিন্ন মামলায় কারাগারে গেছেন। আর একটা বড় অংশ গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপন করেন। ফলে বিএনপি এখন নেতাশূন্য হয়ে পড়েছে।
বিএনপির একটি সূত্রে জানা গেছ, বর্তমানে হরতাল-অবরোধের যে কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে দলের অনেক নেতার মত না থাকলেও দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আত্মগোপনে থেকে এসব কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন। দলের শীর্ষ নেতারা কোনো রকম বৈঠক করে আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে পারছেন না। ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছাড়া দলের নেতাকর্মীদের যেমন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সাধারণ মানুষকেও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারেনি বিএনপি। এতে দলের কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে।
জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুভাষ সিংহ রায় বলেন, ‘বিএনপি রাজনৈতিক কাঠমোর কোনো দল নয়। অনেকে বিএনপিকে বিরোধী দল বলে। কিন্তু আমি এটার সঙ্গে একমত নয়। কারণ বিএনপি বিরোধী মহল। বিরোধী দল আর বিরোধী মহল কিন্তু এক নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি জনমানুষের রাজনীতি করে না। তারা ধ্বংসাত্বক রাজনীতিতেই বেশি পারদর্শী। আন্দোলনের নামে দলটি এখন দেশজুড়ে অগ্নিসন্ত্রাস চালাচ্ছে। যেটির সঙ্গে দলের অনেক শীর্ষ নেতাই একমমত নন। তাদের একজন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব আছেন রুহুল কবির রিজভী, তিনি গুহায় বসে হাওয়ায় বার্তা পেয়ে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যার সঙ্গে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা দলের নেতাকর্মীদেরও সম্পৃক্ততা নেই।’
বিএনপিতে এখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্য এবং দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে নেতাদের বিরোধের কারণে দলটি ছন্নছাড়া বলেও মন্তব্য করেন তিনি।