‘এমপির আর্শিবাদে’ চেয়ারম্যান দখল করেন টিলা-বাগান

‘এমপির আর্শিবাদে’ চেয়ারম্যান দখল করেন টিলা-বাগান

মুদ্দত আলী হবিগঞ্জ জেলা তাঁতী লীগের সভাপতি ও বাহুবল উপজেলার পুটিজুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। রাবার বাগানের জায়গা দখল, টিলা কাটা, সরকারি গাছ কেটে বিক্রি ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের একগাদা অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর দখল-দাপটে এলাকার সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ; কিন্তু ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ। কারণ মুদ্দত আলী নিজের পরিচয় দেন হবিগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজের (মিলাদ গাজী) লোক হিসেবে। 

স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যান মুদ্দত আলী দখলবাজি করে গত কয়েক বছরে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। রাবার বাগান ও টিলার দিকেই তাঁর ‘নজর’ বেশি। বনের জায়গা দখল করে গড়ে তুলেছেন স্থাপনা। ‘এমপির লোক’ পরিচয়ে দাপট দেখিয়ে এসব করেন তিনি। লোকজনকে ‘ম্যানেজ করতে’ টাকা খরচ করেন দেদার। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে নানা ধরনের হুমকি দেন। 

পুটিজুরী ইউনিয়নের রূপাইছড়া রাবার বাগানের আয়তন ১ হাজার ৯৬৩ একর। বাগানটি বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের অধীনে। এই বাগানের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ‘সেগুন টিলা’সহ প্রায় ২৪ একর জায়গা দীর্ঘদিন ধরে মুদ্দত আলীর দখলে। শুধু দখল নয়, সেখানকার মাটি, ছড়ার বালু ও সব গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। এলাকার লোকজন জানান, বছরকয়েক আগে সেখানে ছয় শতাধিক গাছ ছিল, এখন একটিও নেই। নির্বিচার মাটি কেটে নেওয়ায় সেগুন টিলা প্রায় বিলীন। এলাকাটি এখন সমতল ভূমির মতো। 

২০১৩ সালে শ্রমিক লীগের হবিগঞ্জ জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন মুদ্দত আলী। মূলত ওই সময় তিনি রাবার বাগানের ভেতর যন্ত্র দিয়ে বালু তোলা ও গাছ কেটে নেওয়া শুরু করেন। গত বছরের ৭ আগস্ট রাতে রূপাইছড়া রাবার বাগানে ‘সোনার বাংলা রাবার অ্যান্ড ফ্রুটস প্রোডাক্ট প্রজেক্ট’ নামে একটি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন। তাঁর এসব দখলবাজির প্রতিবাদে বাহুবল থানায় একাধিক মামলা ও প্রশাসনের কাছে ডজনখানেক অভিযোগ দিয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোনো ফল হয়নি!

সম্প্রতি রূপাইছড়া রাবার বাগানের সেগুন টিলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু ও মাটি তোলার কারণে জায়গাটি পুকুরের মতো হয়েছে। এলাকাবাসী জানান, সেগুন টিলার পাশে আরেকটি টিলার মাটি-বালু বিক্রি করে মুদ্দত আলী সেটি ধ্বংস করেছেন। তাঁর দখলে রয়েছে আশপাশের আরও তিনটি টিলা।  

এ বিষয়ে রূপাইছড়া রাবার বাগানের ব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুদ্দত আলী স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলেন না। কেউ কিছু বললেই তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়। তবে রাবার বাগানের জায়গা দখল করায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যা এখনও চলছে।’ ওই মামলা দেওয়ার পর তাঁকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মনিরুল বলেন, ‘এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছি।’ 

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মুদ্দত আলী বলেন, ‘কারও বাগান দখল করিনি, টিলাও কাটিনি। বাবার আমল থেকে রাবার বাগানের ওই অংশের মালিকানা আমাদের। এ নিয়ে মামলা চলছে।’ অবৈধভাবে বাগান থেকে বালু উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইজারা নিয়ে আমার জায়গা থেকে বালু তুলেছি। পাঁচ-ছয়টি ছড়ার ইজারাদার ছিলাম। একাধিকবার তদন্ত হয়েছে, কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘রূপাইছড়া বাগানের পরিবেশ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রতিনিয়ত গাছ কাটা, বালু উত্তোলন ও মাটি কাটার ফলে বাগানটি হুমকির মুখে। পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।’

মুদ্দত আলীর দখল করা জায়গা উদ্ধারে গতবছরের আগস্টে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা করে রূপাইছড়া রাবার বাগান কর্তৃপক্ষ। বাহুবল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন ওই মামলার বিষয়ে বলেন, ‘বাগান কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ মামলার পর বাগানের জায়গা মাপজোক করা হচ্ছে। মাপ শেষে প্রতিবেদন দাখিল হবে। সে অনুযায়ী জেলা প্রশাসক ব্যবস্থা নেবেন।’
রিসোর্টের জমি নিয়ে বিরোধবাহুবলের পুটিজুরী ইউনিয়নের মীরের পাড়া গ্রামে ‘সিকাটিলা’র অবস্থান। এর পাশেই ‘দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট’। বৃন্দাবন মৌজার জেএল ২৮ এর ৪০ নম্বর দাগে মোট ৮ একর ৪০ শতক জমি রয়েছে সেখানে। এর মধ্যে ৪ একর ১০ শতাংশ জমি নিজের দাবি করেন এমপি গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ। আবার রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের দাবি- জমিটি তাদের। গত ১৮ জুলাই চেয়ারম্যান মুদ্দতের নেতৃত্বে এক দল লোক ওই জমি দখলে যায় এবং রিসোর্ট ভবনের চারপাশের দেয়ালে রঙ লাগিয়ে দেয়। এলাকার লোকজন বলেন, ‘এমপির লোক’ হিসেবে সেদিনও দাপট দেখান চেয়ারম্যান মুদ্দত আলী।  

প্যালেসের সহকারী ব্যবস্থাপক ওয়েছুর রহমান পাভেল বলেন, ‘৩৯ ও ৪০ নম্বর দাগে মোট ২৮৫ শতক জমি ক্রয়সূত্রে আমাদের। এই জমির বিপরীতে ব্যাংক লোনও রয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান মুদ্দত আলীসহ কিছু লোক জায়গাটি দখল করতে চাইছে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান মুদ্দত আলী গত ১৮ জুলাই সেখানে যাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘জায়গার কাগজপত্র এমপি সাহেবের বোনের জামাইয়ের নামে। সীমানা নির্ধারণ হয়েছে দুই বছর আগে। আমাকে অযথা এতে জড়ানো হচ্ছে।’

আর প্যালেসের বিরুদ্ধে জায়গা দখলের পাল্টা অভিযোগ করে এমপি গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ বলেন, ‘১৯৯৯ সালে জায়গাটি কিনেছি। এটি প্যালেস থেকে অনেক দূরে বৃন্দাবন এলাকায় পড়েছে। মালিকানার কোনো প্রমাণ না থাকার পরও তারা আমার জায়গা দখলের চেষ্টা করছে।’ 

মুদ্দত আলীর নিজেকে ‘এমপির লোক’ পরিচয় দেওয়া প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ বলেন, ‘তিনি (মুদ্দত আলী) ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। দলীয় কর্মী হিসেবে আমার সঙ্গে ওঠাবসা। সেখানে নাম ভাঙানোর কোনো বিষয় নেই।’ -সমকাল