জনসেবার টানা ২০ বনাম ক্ষমতার বাইরে টানা ২২
বিপ্লব কুমার পাল||
আওয়ামী লীগ টানা প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তিন মাসের মাথায় আবারও জাতীয় নির্বাচন। দেশজুড়ে এখন নির্বাচনী ডামাডোল। আগামীতে কে আসবে ক্ষমতায়, কে হবেন প্রধানমন্ত্রী, এনিয়ে চলছে আলোচনা, যুক্তিতর্ক। আর রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে দুই মেরুতে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলো। যাদের প্রধান দুই মুখ আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বিএনপি। আবার আওয়ামী লীগের স্পষ্ট ভাষ্য, শর্তবিহীন সংলাপে আপত্তি নেই কোনো। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশ কয়েক দেশও সক্রিয়। এরইমধ্যে বিদেশি প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল বাংলাদেশ সফর করে গেছে, দিয়েছে মতামত। আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে গ্রহণযোগ্য ভোট হলে কোন দল আসবে রাষ্ট্রের ক্ষমতায়? রাজনীতির মাঠে এটিই সর্ব চর্চিত প্রশ্ন। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে এবং ক্ষমতায় দুই রেকর্ড আওয়ামী লীগের। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের হাতেই উঠে বাংলাদেশের প্রথম শাসনভার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি দেশে ফিরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১২ জানুয়ারি তিনি রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পরে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বাকশাল গঠনের পর আবারও রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এরপর টানা ২১ বছর ক্ষমতা থেকে দূরে ছিল আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই সাবেক প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। আবার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের মতো, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৃতীয় বার এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে এখনো সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
প্রায় ১৬ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে বিএনপি
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের পটভূমিতে ৭ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। আর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি । ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। তখনকার উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার কিছু সময়ের জন্য সরকার ও দলের হাল ধরেন। এরপর টানা ৮ বছর ১১ মাস ২৪ দিন ক্ষমতার বাইরে থাকে বিএনপি। ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ক্ষমতাগ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা হারায় বিএনপি। তবে ২০০১ সালে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় দলটি। সর্বশেষ ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। এরপর থেকে প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে রয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যদি ভোটে হেরে যায়, তাহলে টানা ২২ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকবে বিএনপি। একই সাথে ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ডও করবে দলটি ।
উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি নিয়ে জনগণের কাছে আওয়ামী লীগ
গেল ১৫ বছরে আধুনিক বাংলাদেশে পরিণত করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তব। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট, কম্পিউটার, স্মার্ট ফোন। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশকে আধুনিক অবকাঠামো সমৃদ্ধ করে তুলছে সরকার। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ। এরইমধ্যে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে প্রমত্তা পদ্মায় দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ করা পদ্মা সেতু। ঢাকার বুকে ছুটে চলেছে মেট্রো ট্রেন। প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তর হয়েছে। যমুনা নদীতে নির্মাণ হচ্ছে রেল সেতু। কর্ণফুলী টানেল উদ্বোধনের পথে। কাজ শুরু হয়েছে পাতাল রেলের। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে রামু, কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণকাজ চলছে। এই সময়ে বাংলাদেশ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছে কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাই-১। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণেরও প্রস্তুতি চলছে। ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ঘর উপহার দিচ্ছে বর্তমান সরকার। এছাড়া জনগণের উন্নয়নের জন্য আছে নানা প্রকল্প।
খালেদার মুক্তি আর চিকিৎসার দাবির ঘূর্ণিপাকে বিএনপি
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। বেশিরভাগই আন্দোলনের দাবি ছিল জিয়া পরিবারকে ঘরে। বিএনপিনেত্রীর মুক্তি ও চিকিৎসার দাবির আন্দোলনও ব্যর্থ হয়েছে। সরকারকে বাধ্য করাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার পরিবার স্মরণাপন্ন হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় কারাগারের স্থলে খালেদা জিয়া বাসায় থাকার সুযোগ পাচ্ছেন। বিএনপি তারপরও খালেদা জিয়াকে নিয়ে রাজনীতি করছে। যে কোনো দাবির সাথে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির সাথে দ্রব্যমূল্য কমানোর দাবি জুড়ে দেওয়া হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর সরকারকে উৎখাতের হুঁশিয়ারি দিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি। সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকার পতনের গুজব ভাইরাল করতে পেরেছিল দলটি। পরের দিন দেশের মানুষ বুঝতে পারে তাদের ছলচাতুরি। বিভিন্ন সময় নানারকম দফা দিয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা করেছে বিএনপি। বর্তমানে এক দফার দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে করছে দলটি। কিন্তু সেই এক দফার মধ্যে রয়েছে চারটি দফা।
এবার জনসেবার টানা ২০ নাকি ক্ষমতার বাইরে ২৩
দরজায় কড়া নাড়ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি সব দল নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ লড়াই হবে। কারণ এই দুই দল ছাড়া অন্যদের জনসমর্থন খুব একটা নেই। যদি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় তাহলে একটানা ২০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার রেকর্ড করবে। যাদের টানা ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকারও রেকর্ড রয়েছে। নৌকার পক্ষে ফল এলে, এক টানা রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে থাকার রেকর্ডটি চলে যাবে বিএনপির হাতে।
আগামী নির্বাচনে কোন দল জয়ী হতে পারে, এই প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই বলেছে তারাই জয়লাভ করবে। বিএনপি চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর আওয়ামী লীগ বলছে, সংবিধান মেনেই হবে সংসদ নির্বাচন। যদি ১৯৯৬ সালের মতো আওয়ামী লীগের দেখানো পথে সরকারকে বাধ্য করাতে পারে বিএনপি, তখন পরিস্থিতি হবে অন্যরকম। কিন্তু বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন রাষ্ট্রের অবস্থা কেমন ছিল? তখন জঙ্গিবাদের বিস্তার ছিল, গ্রেনেড হামলা ছিল, দুর্নীতির কেন্দ্র হাওয়া ভবন ছিল, সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল ছিল। উল্লেখ করার মতো কোনো অর্থনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নও ছিলনা।
এদিকে টানা প্রায় ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলটির কিছু নেতার কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ উঠেনি। সারাদেশের সুষম উন্নয়ন বর্তমান সরকারের বড় অর্জন। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০২৮ সালে পাল্টে যাবে দেশের চিত্র। আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশন নিয়ে বিরোধীরা অনেক তাচ্ছিল্য করেছিল। তাদের মুখে ছাই দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন দেশের জনগণের অহংকার। আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ করতে চায় আওয়ামী লীগ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিটি ভোটারকে চিন্তা করা দরকার। দলমত নির্বিশেষে সবার। এজন্য নিজেকে অন্তত ১০টি প্রশ্ন করা প্রয়োজন। নিজের কাছে নিজের ১০টি প্রশ্ন। যার উত্তরদাতাও নিজেই। আমি তাকে কেন ভোট দেব? স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেব? সব মানুষের কল্যাণের জন্য ভোট দেব নাকি শুধু নিজের লাভটি দেখব? অমুককে ভোট দিয়ে আমি বা আমরা কী পেয়েছিলাম? গেল ১৫ বছরে আমার জেলা/ আমার উপজেলা/ আমার গ্রাম কেমন ছিল আর এখন কেমন হয়েছে? আমার গ্রামের গরিব মানুষ সরকারের সহযোগিতা পেয়েছে? আমাদের গর্ব করার মতো উন্নয়ন কি দেশে সত্যিই হয়েছে? দেশ কি স্মার্ট বাংলাদেশ হয়েছে? ১৫ বছর আগে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের উত্থান কেমন ছিল, আর এখন কেমন আছে? দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ১৫ বছরের আগের চেয়ে ভালো নাকি খারাপ? ১০টি প্রশ্নের উত্তরে বেশি নম্বর যে দল পাবে তাকে ভোট দেওয়া প্রয়োজন দেশের স্বার্থে।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।