মাধবপুরে আখড়ায় অনিয়ম, নেই আয়-ব্যয়ের হিসাব
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণ গোসাই আখড়ার আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই কমিটির কাছে। দীর্ঘদিন যাবত হচ্ছে না নতুন কমিটি। একটি চক্র পকেট কমিটি বানিয়ে লুটে-পুটে খাচ্ছে আখড়ার সম্পত্তি। কত বছর পূর্বে কমিটি হয়েছে তাও সঠিকভাবে বলতে পারছে না আখড়া পরিচালনা কমিটি।
মাধবপুর উপজেলার বহরা ইউনিয়নের অন্তর্গত কৃষ্ণপুর এলাকায় বিশাল এলাকাজুড়ে অবস্থিত কৃষ্ণ গোসাই আখড়া। ত্রিপুরার মহারাজা বীর চন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের দানকৃত ভূমির উপর এই আখড়া প্রতিষ্টা করা হয়। তবে কবে নাগাদ এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করা হয় তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে শত বছরের পুরনো এই আখড়া।
৩২ একর জায়গা নিয়ে থাকা আখড়ায় একটি দিঘিসহ রয়েছে ৪টি পুকুর। রয়েছে ফসলি জমিও। এত বিশাল সম্পত্তি থাকলেও আখড়ার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। একটি দেয়ালঘেরা ঘর আর একটি সীমানা প্রাচীর ছাড়া তেমন কোনো উন্নয়ন চোখে না পড়লেও আখড়ার আয় ও ব্যয়ের হিসাব নেই কারও কাছে। মাধবপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র হিরেন্দ্র লাল সাহা থেকে শুরু করে অনেক নামি-দামি লোকজন এই আখড়ার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করলেও হিসাবের খাতা নেই।
বর্তমানে এই আখড়ার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কামেশ রঞ্জন কর ও সাধারণ সম্পাদক হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ মাধবপুর উপজেলার আহ্বায়ক হরিশ চন্দ্র দেব। তারা কত সালে এই কমিটিতে এসেছেন তারও সঠিক তথ্য দিতে পারেননি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। অপরদিকে কমিটির নেই কোনো অর্থ সম্পাদক, নেই দপ্তর সম্পাদক।
মাধবপুরস্থ জনতা ব্যাংকে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে আখড়ার। সেটাও সাধারণ সম্পাদক হরিশ চন্দ্র দেব ও সহ-সভাপতি প্রমোদ দেব নাথের নামে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ সম্পাদক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদবি। কিন্তু এই আখড়ার পরিচালনা কমিটির নেই অর্থ সম্পাদক। দপ্তর সম্পাদকের কাছে খাতা-পত্র, হিসাব-নিকাশ থাকার নিয়ম থাকলেও নেই দপ্তর সম্পাদক। এ যেন হরিশ দেবের একচ্ছত্র আধিপত্য।
স্থানীয় অনেক হিন্দু ব্যক্তি জানান, আখড়ার কমিটি কবে কখন হয় তা কেউ জানে না। হরিশ চন্দ্র দেব নিজের পছন্দমতো লোক নিয়ে পকেট কমিটি করে দীর্ঘদিন যাবত আখড়া পরিচালনা করছেন। তার পছন্দের লোক না হলে আখড়ার কমিটিতে নেওয়া হয় না। তাছাড়া শত বছরের পুরনো এই আখড়ার দিঘি, পুকুর, ফসলি জমি থাকলেও আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই।
এই আখড়ায় ৪ বছর যাবত পূজা-অর্চনা করেছেন সোনাতন গোসাই। তিনি জানান, দীর্ঘ ৪ বছর যাবত তিনি এই আখড়ায় থেকে ভগবানের পূজা-অর্চনা করে গেলেও তার কোনো বেতন নেই। ভক্তরা এখানে এসে যে দক্ষিণা দেন তা দিয়েই তিনি চলেন। আখড়ার আয়-ব্যয় কেমন জানতে চাইলে তিনি জানান, এগুলো তিনি বলতে পারবেন না। এগুলো জানেন সেক্রেটারি।
মনতলা বাজারের ব্যবসায়ী রেনু ধর বলেন, এটি একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এই আখড়ার অনেক ধন-সম্পত্তি আছে। এটার আয়-ব্যয়ের হিসাবের দায়িত্বে আছেন হরিশ চন্দ্র দেব। আমরা বছরে এক-দুইবার যাই কোনো উৎসব হলে। বছরে একবার মেলা হয়। নিমন্ত্রণ পেলে যাই।
ভবানিপুর গ্রামের নিতাই দেব জানান, ৪ জন লোকই এই আখড়ার সর্বেসর্বা। কোনো সভা করে আনুষ্ঠানিকভাবে কমিটি গঠন করা হয় না। যখন পূজা ও মেলাহয়, তখন সভা ডাকা হয়। আখড়ার কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন কাউকে দেওয়া হয়নি।
ভবানিপুর গ্রামের মিহির ভট্টাচার্য জানান, কার্যকরি কমিটি করার সময় কাউকে বলা হয় না। তারা (সভাপতি-সেক্রেটারি) নিজেরা মিলে কমিটি করে থাকেন।
এ ব্যাপারে আখড়ার সাধারণ সম্পাদক হরিশ চন্দ্র দেব জানান, আখড়ার কার্যকরি কমিটির সদস্য ১৫ জন। অর্থ সম্পাদক, দপ্তর সম্পাদক নেই। সভাপতি, সেক্রেটারি বাদে বাকি সবাই সদস্য। আখড়ার নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেটি সাধারণ সম্পাদক হরিশ চন্দ্র দেব ও সহ-সভাপতি প্রমোদ দেব নাথের নামে। আখড়ার ৩২ একর জায়গা রয়েছে। আখড়ার ২ একর জায়গা অন্যের দখলে ছিল। সেগুলো কিনে আবার আখড়ার নামে করা হয়েছে। তারা গত বছর একটি ভবন করেছেন। সেটি করতে ৫০/৬০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া পুকুরে ৩০০ ফুটের মতো গার্ড ওয়াল দেওয়া হয়েছে। বাউন্ডারি তৈরি করা হয়েছে।
৪টি পুকুর লিজ বাবদ কত টাকা পান জানতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
কোনো ফান্ড আছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, কোনো ফান্ড নেই। ধান বিক্রি হচ্ছে, খরচ হচ্ছে, এভাবেই চলছে।
বার্ষিক প্রতিবেদনের কোনো কপি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, বার্ষিক প্রতিবেদনের কোনো কপি নেই। অনেক আগে একবার অডিট হয়েছিল। তবে বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো খুঁজলে পাওয়া যাবে। তার বাড়ি পুড়ে যাওয়াতে অনেক রেকর্ড পুড়ে গেছে।
আপনারা নিজেদের মতো করে কমিটি করেন, কমিটি করার সময় কাউকে বলা হয় না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেককে বলা হয়, তারা আসে না। তারা না এলে আমি কী করবো?
আখড়া পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামেশ রঞ্জন কর জানান, আখড়া পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটি আছে। কমিটির সভাপতি তিনি, সাধারণ সম্পাদক হরিশ চন্দ্র দেব। আখড়ার হিসাব-নিকাশ এগুলো হরিশ চন্দ্র দেবই করে থাকেন। আখড়ার একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, সেটা সাধারণ সম্পাদক হরিশ চন্দ্র দেব ও সহ-সভাপতি প্রমোদ দেব নাথ পরিচালনা করেন।
মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বহরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আলাউদ্দিন জানান, তিনি এবার নিয়ে ৩ বার চেয়ারম্যান হয়েছেন। কিন্তু কখনও তাকে কোনো সভায় ডাকা হয়নি। আখড়ার বিশাল সম্পত্তি রয়েছে। অনেক বড় বড় গাছ ছিল। সেগুলো কমিটির লোকজন বিক্রি করেছে।
তিনি আরও জানান, কৃষ্ণপুর আখড়া একটি প্রাচীন আখড়া। এই আখড়ার অনেক সম্পত্তি। যারা আখড়ার দায়িত্বে আছে তারা এটা লুটে খাচ্ছে। কোনো সভা হয় না। সভাপতি-সেক্রেটারি নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করেন। এটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হলেও এর ভালো-মন্দ দেখার দায়িত্ব সকলের। তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে সবসময় আখড়ার উন্নতি কামনা করেন। কিন্তু আখড়ার কোনো কাজে তাকে ডাকা হয় না। তাই ইচ্ছা থাকলেও তিনি সেখানে যেতে পারেন না।