লাউয়াছড়া বনে আগুন জ্বালিয়ে চিত্রগ্রহণ!
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল "লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে" আগুণ জ্বালিয়ে চিত্রগ্রহণ করছে একটি চিত্রগ্রহণকারী সংস্থা৷ বুধবার (৮জুন) সকাল থেকে লাউয়াছড়া বনের অভ্যন্তরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর, লাইট, ভারী যন্ত্রপাতি এবং ট্রাক ও মাইক্রোবাস নিয়ে লাউয়াছড়া বনে চিত্রগ্রহণের জন্য প্রবেশ করে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের নিজস্ব প্রোডাকশন হাউজের লোকজন৷
প্রাণ-আরএফল গ্রুপের কোমল পানীয় "পাওয়ার এনার্জি ড্রিংক" এর চিত্রগ্রহণের জন্য তারা লাউয়াছড়ায় এসেছেন বলে জানিয়েছেন চিত্রগ্রহণের সাথে সংশ্লিষ্টরা৷
সংরক্ষিত বনের কোর জোনের ভেতর লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া পাহাড়ী ছড়ার সামনে সকাল থেকে চিত্রগ্রহণ শুরু করে তারা৷ এসময় তারা চিত্রগ্রহণের জন্য বনের ভেতর তেলের টিনে আগুণ লাগিয়ে ধোঁয়ার সৃষ্টি করে৷ এসময় বনের দুই কিলোমিটার জুড়ে এই ধোঁয়া ছড়িয়ে পরে৷
চিত্রগ্রহনের জন্য প্রোডাকশন টিমটি সংরক্ষিত বনের ভেতর ৮টি মাইক্রোবাস,দুটি ট্রাক ও কয়েকটি ইজিবাইক নিয়ে প্রবেশ করে৷
সরেজমিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে গিয়ে দেখা যায়, চিত্রগ্রহণকারী দলটি বনের অভ্যন্তরে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর চালিয়ে চিত্রগ্রহণের কাজ করছে৷ বনের ভিতরে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা করার জন্য নিয়ে এসেছে হাজার ওয়াটের বাল্ব৷ চিত্রগ্রহণের কাজে ব্যবহৃত জেনারেটরটি থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া বনের চারপাশে ছড়িয়ে গিয়েছে৷
প্রোডাকশন টিমের সদস্যরা বনের ভেতর পায়ে হাঁটার ট্রেইলের উপর তাঁবু টাঙ্গিয়ে তাদের চিত্রগ্রহণ করার জন্য নিয়ে আসা সামগ্রীগুলো রেখেছেন৷ এসব ভারী ভারী যন্ত্রাংশ বনের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখায় ছোট ছোট অনেক উদ্ভিদ নষ্ট হয়েছে৷
লাউয়াছড়ার ভিতর দিয়ে যাওয়া ছড়াতে নেমে চিত্রগ্রহণ করতে দেখা গেছে প্রোডাকশন হাউজের লোকদের৷ তারা প্রায় ৩০-৪০ জনের দল ছড়াতে নেমে চিত্রগ্রহণ করার কাজ করছিলেন৷ এসময় বন্যপ্রাণিদের অভয়াশ্রম বলে পরিচিত ওই জায়গাটিতে বণ্যপ্রাণিদের দ্বিগিদ্বিক ছোটাছুটি করতেও দেখা গেছে৷
এদিকে চিত্রগ্রহণকারী দলটির খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য বনের ভেতরেই গ্যাস সিলিন্ডারের মাধ্যমে চুলা জ্বালিয়ে রান্না করা হচ্ছে৷ পাশাপাশি চিত্রগ্রহণকারী দলটির খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো স্তুপ আকারে জমিয়ে রাখা হয়েছে৷
চিত্রগ্রহণের জন্য প্রোডাকশন টিমটি লাউয়াছড়া থেকে বেত গাছ কেটেও নিয়েছেন এবং সেই কেটে নেয়া বেতগাছটি তাঁদের চিত্রগ্রহণের কাজে ব্যবহারও করছেন৷
এদিকে এই চিত্রগ্রহণকারী দলটিকে বনবিভাগের বনকর্মী ও সিপিজি সদস্যরা সাহায্য করতেও দেখা গেছে৷
তবে লাউয়াছড়া বনের প্রবেশ পথের টিকেট কাউন্টারে বিকেল তিনটা আটাশ মিনিটের সময় খোঁজ নিয়ে জানা যায় চিত্রগ্রহণকারী দলটি বনে প্রবেশের জন্য কোন টিকেট ক্রয় করে নি৷
উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটরটির শব্দ বনের প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকায় বণ্যপ্রাণীরা আতঙ্কিত অবস্থায় ছুটোছুটি করতেও দেখা গিয়েছে৷
প্রোডাকশন হাউজের স্পট বয় ইয়াসিন সিলেটটুডেকে বলেন, আমরা সকাল সাতটায় এখানে শ্যুটিং করতে এসেছি৷ এখানে আমাদের ৩৫ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি জেনারেটর আনা হয়েছে পাশাপাশি আমরা যে আলো জ্বালানো হচ্ছে সেগুলোর ক্ষমতা প্রায়৷২৭ হাজার কিলোওয়াট৷
ঠিক কতজন এখানে চিত্রগ্রহণ করতে এসেছেন, জানতে চাইলে ইয়াসিন জানান, আমরা এখানে প্রায় ৫০ জনের মতো সদস্য আছি৷ ইয়াসিন আরো জানান, সকালে এখানে আসার সময় একটি বানর গাছে বসে কাঠাল খাচ্ছিলো, ওই বানরটি তাকে আঘাত করে৷
এদিকে লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাসিন্দা সাজু মারছিয়াং জানান, মহাবিপন্ন উল্লুক, চশমা বানর, মুখপোড়া হনুমানের বিচরণ এলাকায় বুধবার সকাল থেকে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি জেনারেটর ও শতাধিক লোক নিয়ে বনের গভীরে চলছে প্রান কোম্পানির এ্যানার্জি ড্রিংকস পাওয়ার এর শ্যুটিং এর কার্যক্রম। এ সময় ঐ এলাকায় আগুনের মাধ্যমে ধোয়া উড়াতে দেখা গেছে। ওখানে সকাল থেকে একদল হনুমান ছিল কিন্তু ইউনিট সাজানোর পর অনেকে হনুমানগুলো কে বিরক্ত করেছিল তখন আমি ও বণ্যপ্রাণী গবেষক শিমুল নাথ চিত্রগ্রহণকারী দলের কাছে গিয়ে বুঝাই প্রাণিদের বিরক্ত না করতে। এরপর ওখানে আগুণ লাগিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে দেয়া হয় ওখানে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য বিভাগের শিক্ষার্থী ও গবেষক শিমুল নাথ গণমাধ্যমকে বলেন, আজ সকালে আমি লাউয়াছড়ায় গিয়ে দেখি একটি শ্যুটিং ইউনিট এসেছে। যেখানে তারা ইউনিট সেটাপ করেছে তার আশেপাশে প্রচুর হনুমান ও অনান্য বণ্যপ্রাণিরা থাকে৷ এখন যেহেতু বর্ষাকাল তাই তারা এখন খাবারও পায় প্রচুর এখানে৷ এভাবে হৈ চৈ করে চিত্রগ্রহণের ফলে বণ্যপ্রাণিদের ক্ষতি হচ্ছে৷
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রোডাকশন হাউজের লাইন ডিরেক্টর এবিএম রন্টু জানান, আমরা বনবিভাগের কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়ে কাজ করতে এসেছি। বনবিভাগ আমাদের কোন নির্দেশনা দেয় নি, আমরা এর আগেও এখানে এভাবে চিত্রগ্রহণ করেছি৷
বনের ভেতর আগুণ জ্বালানোর ব্যাপারে তিনি বলেন, আমরা আসলে ধূপ দিয়ে ধোঁয়া উৎপন্ন করেছি, আগুণ জ্বালাই নি৷ আগুণ ছাড়া ধূপ কিভাবে জ্বালালেন এই প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি৷
প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষন বিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, বনবিভাগের এমনটি করা উচিত হয় নি। মাত্র ৩ দিন হয় নি প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পরিবেশ, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণের কথা বলেছেন। আর মাত্র তিন দিন পরেই কি করে বনবিভাগ এই কাজ করতে পারে। লাউয়াছড়ার দায়িত্ব এ এখন যারা আছেন তাদের অনেক ভাল কাজ আজ ম্লান ও নষ্ট হয়ে গেল। এদের নাম সবাইকে জানানো দরকার।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, লাউয়াছড়া বনে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং খুবই বাজে কাজ হয়েছে। সংরক্ষিত বনের ভেতর বন বিধ্বংসী অপকর্মের অনুমোদন কে দিয়েছে? বনের ভেতর নজিরবিহীন এই শুট্যিং আয়োজনের কারনে বনে আর বন্যপ্রাণী থাকতে পারবে না।
মৌলভীবাজার বণ্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বলেন, আমি চিত্রগ্রহণকারী দলটিকে টিকেট দেখাতে বললেও উনারা তা দেখাতে পারেন নি আমাকে৷ আসলে এভাবে বনের ভেতর চিত্রগহণ করাটাই উচিত না, পুরো প্রক্রিয়াটাতেই বনের ক্ষতি হয়৷ বনের ভেতরে একটা গ্যাসলাইট নিয়ে প্রবেশ করাও নিষেধ সেখানে তারা জেনারেটর চালাচ্ছে আগুণ লাগিয়ে ধোঁয়া তৈরী করছে৷ আমি বিষয়টি দেখছি কি করা যায়৷
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষন বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, রাজস্ব খাতে টাকা জমা দিয়ে লাউয়াছড়ায় চিত্রগ্রহণ করা যায় এবং এর জন্য আমাদের কোন অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন নেই৷ আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তারা টিকিট কেটেছে৷ বনে আগুন জ্বালানো বা লাইট জ্বালানো কিংবা ছড়ার কোন ক্ষতি করা আইনবহির্ভূত, এটা তারা করতে পারে না৷ আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিবো তাদের বিরুদ্ধে৷
বনকর্মীরাও তাদের সাথে মিলে এই কাজ করছেন, তাদের ব্যাপারে কি হবে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন তদন্তসাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে৷