সিলেট আওয়ামী লীগে বিরোধ, নেতাদের উপর তৃণমূলের ক্ষোভ
সিলেট আওয়ামী লীগে ক্ষোভ আর অর্ন্তদ্বন্দ্ব থাকলেও তা এতোদিন প্রকাশ্যে আসেনি। দীর্ঘক্ষণ ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। এবার ইউনিট কমিটি নিয়ে প্রকাশ্যে এসেছে বিরোধ। তবে নির্বাচনের পূর্ব মূহূর্তে যখন ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে আওয়ামী লীগ, তখনই সিলেটে দলটিতে বাড়ছে ক্ষোভ।
কমিটি গঠন নিয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়েছেন সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা। ইউনিট কমিটি নিয়ে ক্ষমতাসীন সংগঠনটিতে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। জেলা ও মহানগরের শীর্ষস্থানীয় নেতারা তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে নিজেদের পছন্দের লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে সিলেট জেলা ও মহানগরের আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। তিন বছর মেয়াদি এই কমিটি শেষ সময়ে এসে ইউনিট কমিটিগুলো গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। আর এতে করে প্রকাশ্যে এসেছে তৃণমূলের বিরোধ।
কমিটি গঠন নিয়ে সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলন করে জেলা ও মহানগরের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছেন পদবঞ্চিতরা।
একাধিক নেতা জানিয়েছেন, সিলেট আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি আগে থেকেই ছিল। তবে দল ক্ষমতায় থাকায় তা কখনোই প্রকাশ্যে রূপ নেয়নি। দলের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলতে দেখা যায়নি। তবে এবারই তার ব্যতিক্রম হলো।
কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। পদপ্রত্যাশী অনেকেই থাকেন। কিন্তু সবাইকে পদ দেয়া সম্ভব হয় না। যারা পদ পান না, তারা নানা অভিযোগ করেন। এসবের সত্যতা নেই।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পদে ‘বিএনপি নেতা’
গত ২৩ অক্টোবর সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুর রহমান চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সদর উপজেলা কমিটিতে নিজাম উদ্দিনকে সভাপতি ও হিরণ মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার কথা জানানো হয়।
তবে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার অভিযোগ, দলীয় গঠনতন্ত্র না মেনে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া নতুন কমিটিতে সাধারণ হওয়া হিরণ মিয়া যুক্তরাজ্য বিএনপির পদধারী নেতা ছিলেন।
শনিবার (২৯ অক্টোবর) বিকেলে এই কমিটি বাতিলণের দাবিতে সদর উপজেলার তেমূখীতে বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন বিক্ষোব্ধ নেতাকর্মীরা। মিছিল থেকে এই কমিটিকে অবৈধ আখ্যায়িত করে তা বাতিলের দাবি জানানো হয়।
এরআগে গত ২৫ অক্টোবর সিলেটে সংবাদ সম্মেলনও করেন বিক্ষুব্ধ নেতারা। এতে সিলেট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আমির উদ্দিন বলেন, ‘২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর নিজাম উদ্দিনকে সভাপতি ও হিরণ মিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে সময় হিরণ মিয়া যুক্তরাজ্যের কর্টন শহর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন অভিযোগ উঠলে শেখ হাসিনার নির্দেশে ওই কমিটি দুই দিনের মাথায় বাতিল হয়।
‘এবার উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা বা সম্মেলন ছাড়াই হঠাৎ করে জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা দুই কমিটি করলেন।’
সংবাদ সম্মেলনে আমির উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, হিরণ মিয়া যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালে ২০১৫-১৬ সালে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের সদস্যও নন তিনি।
তবে বিএনপি সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে হিরণ মিয়া বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছি। একটি মহল প্রথম থেকেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আমি কখনই বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।’
মহানগরে সাধারণ সম্পাদকের ‘পকেট কমিটি’
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সম্মেলনে অনেকটা চমক হয়েই এসেছিল সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি। মহানগরের তৎকালীন সভাপতি ও সাবেক সিটি মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের বদলে সভাপতি হিসেবে কেন্দ্রীয় নেতারা বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদের নাম ঘোষণা করেন। সাধারণ সম্পাদক হন সেই সময়ের স্বল্প পরিচিত নেতা জাকির হোসেন।
প্রায় তিন বছর পর নিজেদের অধীন ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েছে এই কমিটি। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি আগামী সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচনকে লক্ষ্য করে নিজের পছন্দের লোকদের দিয়ে প্রতি ওয়ার্ডে পকেট কমিটি করছেন জাকির।
গত দুই মাসে নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে তোপের মুখে পড়ে একটি ওয়ার্ডের কমিটি স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
১২টি ওয়ার্ডের সম্মেলনের মধ্যে তিনটিতে সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ৬টি ওয়ার্ডের নেতৃত্ব বিএনপি-জামায়াত পরিবার ও সাধারণ সম্পাদকের আত্মীয়-স্বজনদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
১০ অক্টোবর ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনে নেতা-কর্মীরা ভোটের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচনের দাবি তোলেন। কিন্তু জাকির হোসেন এতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজের মামাতো বোনের জামাই সাজুয়ান আহমদকে সভাপতি ও তার আস্থাভাজন শফিকুল ইসলাম আলকাছকে সাধারণ সম্পাদক ও আবদুল মুকিতকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেন। কাউন্সিলে আলকাছ প্রার্থীই ছিলেন না।
এই কমিটি ঘোষণার পর ক্ষোভ দেখা দেয়, যা একপর্যায়ে সংঘর্ষে রূপ নেয়। সেদিন চুপিসারে সম্মেলন স্থল থেকে চলে আসেন জাকির হোসেন। এরপর পরিস্থিতি সামাল দিতে কমিটি স্থগিত ঘোষণা দেন সভাপতি মাসুক উদ্দিন।
এ ব্যাপারে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব খান মাছুম বলেন, ‘মেয়র পদে প্রার্থী হতে দল নিয়ে খেলছেন জাকির হোসেন। তিনি দলের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মাইম্যান তৈরি করছেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও আজ্ঞাবহ মানুষ দিয়ে পকেট কমিটি করছেন।’
গত ১৩ অক্টোবর হয় ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলন। ওই সম্মেলনেও তৃণমূলের নেতা-কর্মী ও প্রার্থীরা ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের দাবি তোলেন। কিন্তু তাদের দাবি উপেক্ষা করে মহানগরের নেতারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ঘোষণা দেন।
ওই ওয়ার্ডে সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন সাবেক সহসভাপতি আতিকুর রব চৌধুরী জুয়েল। তিনি বলেন, ‘একটি কক্ষের মধ্যে আমাদের জিম্মি করে সই নেয়া হয়েছে। ঘোষিত কমিটি না মানলে বহিষ্কারেরও হুমকি দিয়েছেন জাকির হোসেন। পরে কমিটিতে জাকির হোসেন তার ভাগ্না জাহিদুল হোসেন মাসুদকে সাধারণ সম্পাদক করেন।
‘জাহিদের ভাই শহিদুল হোসেন মামুন ওয়ার্ড বিএনপির সদস্য। তার আরেক ভাই জামায়াত করেন। ২১ নম্বর ওয়ার্ডেও জাকির যাকে সাধারণ সম্পাদক করেছেন, তার আপন ভাই ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি।’
৪ সেপ্টেম্বর ২৫ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সম্মেলন করতে গিয়ে নিজের পছন্দের লোকজনের নাম ঘোষণা করতে না পেরে কমিটি ঘোষণা না করেই চলে আসেন নেতারা। সে সময় সম্মেলনস্থলে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিটি ঘোষণা করা হয়।
২৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও সিটি কাউন্সিলর তাকবিরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ‘এই কমিটি তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দল শক্তিশালী করতে এসে সাধারণ সম্পাদক দলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। এতে দলই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘১২টি ওয়ার্ড কমিটির মধ্যে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে একটি স্থগিত করতে হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক জাকিরের বিরুদ্ধে নিজের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনদের পদ দেয়ার অভিযোগ অনেকে করছেন। কিন্তু এই অভিযোগ সময়মতো কেউ করছেন না। তবে এসব ব্যাপারে সাধারণ সম্পাদককেও আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।’