হবিগঞ্জ-৪ আসন: বিমানমন্ত্রীর আসনে ব্যারিস্টার সুমন কতটুকু জনপ্রিয়?

হবিগঞ্জ-৪ আসন: বিমানমন্ত্রীর আসনে ব্যারিস্টার সুমন কতটুকু জনপ্রিয়?

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী চার হেভিওয়েট প্রার্থী। ভোটের মাঠে সবাই সরব। যোগাযোগ রাখছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে। এলাকায় চাইছেন জনসমর্থনও। বর্তমান এমপি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এলাকা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এই সুযোগ কাজে লাগাতে চান জনপ্রিয় নেতা ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনসহ অন্য প্রার্থী। আওয়ামী লীগের দুর্গে মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত মনে করছেন তারা।

সরেজমিনে নির্বাচনী এলাকা চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা ঘুরে জানা যায়, বর্তমান এমপি বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এই আসনে ফের মনোনয়ন চাইবেন। তিনি গত দু’বারের এমপি। যদিও ব্যক্তিগতভাবে সজ্জন হিসেবে পরিচিত এই নেতার এলাকায় কাজ কম। আসেনও কম। গত মেয়াদে তিনি ঢাকায় আইন পেশা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, এলাকায় তেমন সময় দেননি বলে অভিযোগ ভোটারদের। এবার প্রতিমন্ত্রী হওয়ায় এলাকাবাসী নানান স্বপ্ন দেখলেও কার্যত তার দেখা পান না।

এছাড়াও মাহবুব আলী মাধবপুর সদরে অন্যের প্রতিষ্ঠা করা সৈয়দ উদ্দিন কলেজের নাম পরিবর্তন করে নিজের বাবা ‘মাওলানা আসাদ আলী’র নামে করায় এলাকায় বেশ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন।

এসব বিষয়ে মাহবুব আলীর জানান, গত মাসেই চার-পাঁচবার এলাকায় গেছেন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে এর চেয়ে বেশি যেতে পারেন না।

মনোনয়ন ও জয়ের ব্যাপারে বেশ আশাবাদী আওয়ামী লীগের এই নেতা। তিনি মনে করেন, তিনি এলাকায় ভালো কাজই করেছেন। সে কারণে গত দুবার যেভাবে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন, আগামীতেও পার হবেন।

তার পাশাপাশি এই আসনে গত দুবারই মনোনয়ন চেয়েছেন সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। এবারও চাইবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় এই নেতা এলাকায় ক্রীড়া কর্মসূচিসহ নানান সামাজিক কাজ করছেন। নিজ অর্থায়নে এলাকায় ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছেন। কেউ বিপদে পড়লে এগিয়ে যাওয়ায় তার স্তুতি আছে বেশ। এলাকা ঘুরে তার প্রমাণও মেলে।

স্থানীয়রা বলছেন, সুমন দুই দলের বাইরে স্বতন্ত্র দাঁড়ালেও জিতবেন। মাহবুব আলীর ব্যস্ততা বা নীরবতায় তিনি এলাকায় সে অবস্থানটা করে নিয়েছেন।

মনোনয়নের বিষয়ে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেন, ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আমি গত দুবার মনোনয়ন চেয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অনেক দিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি। আমি মূলত তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করি। আমাকে দিলে লোকজন এটা মনে করে যে, সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে পাস করবো।’

চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর হোসেন জিতুও মনোনয়ন চাইবেন এই আসনে। তিনি বলেন, ‘এই আসনে মনোনয়নে আমি হকদার। গতবারই তো পাইতাম। ২০০১ সাল থেকে মনোনয়ন চাচ্ছি। নেত্রী (আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) আমাকে ২০০১ সালেই চিঠি দিয়ে বলেছেন আমাকে দেবেন। তখন এনামুল হক মোস্তফা শহীদ সাহেবকে মনোনয়ন আর আমাকে চিঠি দিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন। বলেছেন, ভবিষ্যতে আপনাকে মূল্যায়ন করা হবে। সেই ২০০১ থেকে সব নির্বাচনে আমি মনোনয়ন চেয়ে আসছি।’

তিনি বলেন, ‘এই আসনে যিনি এখন এমপি ও প্রতিমন্ত্রী তার সম্পর্কে আমি বলবো কেন, আপনি জরিপ নিয়ে দেখেন- তার অবস্থান শূন্যের কোঠায়। তার সঙ্গে নেতাকর্মীদের কোনো যোগাযোগ নেই। সাংগঠনিক কোনো কর্মসূচিতে নেই। মাধবপুর উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা এবং চুনারুঘাট উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন একটি পৌরসভা। প্রত্যেক ইউনিয়নের সভাপতি-সম্পাদককে জিজ্ঞেস করে দেখেন, সবাই আমার কথা বলবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফরাস উদ্দিনও গত নির্বাচনে এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান। তবে এবার তিনি চাইবেন না বলে জানিয়েছেন।

এ আসনটিতে স্বাধীনতার পর দুবার জাতীয় পার্টির এমপি ছিল। পরে আওয়ামী লীগের হাতে এলে আর হাতছাড়া হয়নি। ’৯১ থেকে চারবারের এমপি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও প্রয়াত সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ। তার মৃত্যুর পর বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী গত দুবারের এমপি। ভোটের হিসাবে এখানে সব সময় আওয়ামী লীগ এগিয়ে, বিএনপি ৪০ শতাংশ ভোট পেলে আওয়ামী লীগ পায় ৫০ শতাংশ।

চুনারুঘাট ও মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৪২ নম্বর আসন হবিগঞ্জ-৪। এতে মোট ভোটার ৪ লাখ ২৭ হাজার ৫২৫। পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৩ হাজার ২৯৪ ও নারী ভোটার ২ লাখ ১৪ হাজার ২৩১।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৮) আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী পান ৩ লাখ ৮ হাজার ৭২৭ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট শরিক খেলাফত মজলিশ মহাসচিব আহমেদ আব্দুল কাদের ৪৬ হাজার ১৮৩ ভোট পান।

১০ম সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) আওয়ামী লীগের মাহবুব আলী নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ২২ হাজার ৪৩৩ ভোট পান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ তানভীর আহমেদ তালা প্রতীকে পান ১৪ হাজার ৭৬০ ভোট।

৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৯৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ১ লাখ ২৪ হাজার ৭৮৮ ভোট।

৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ১ লাখ ৭ হাজার ৩৭৬ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ৯৩ হাজার ৩১ ভোট।

৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) আওয়ামী লীগের এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে ৭০ হাজার ২৪০ ভোট পান। বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল ধানের শীষ প্রতীকে পান ৫৯ হাজার ৬৬৬ ভোট।

৫ম সংসদ নির্বাচন (১৯৯১) আওয়ামী লীগের প্রার্থী এনামুল হক (মোস্তফা শহীদ) নৌকা প্রতীকে পান ৬৭ হাজার ৮৪৭ ভোট। তার নিকটতম বিএনপির সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল পান ৫১ হাজার ৬৯৪ ভোট।

এবারও এই আসনে নৌকার বিজয় হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, এটি বরাবরই নৌকার ঘাঁটি। যেই নৌকা পাক, জিতবে। কারণ এলাকাটি চা বাগান অধ্যুষিত। চুনারুঘাটে ১৮টি বাগান, মাধবপুরে চার-পাঁচটা। এসব বাগানের চা শ্রমিকরা একচেটিয়া নৌকায় ভোট দেন।

তবে মাধবপুরে বিএনপির আধিক্য আছে। সেখানে সায়হাম গ্রুপের মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়সাল নাগরিকদের নানান সুবিধা দেন। সেজন্য তারা তার পক্ষে ভোট দেন। সৌজন্যে - জাগোনিউজ