২০০ বছরে ঐতিহ্যের মসজিদ!

২০০ বছরে ঐতিহ্যের মসজিদ!

দীর্ঘদিন ধরে অযন্ত, অবহেলা আর সংস্কারের অভাবে চাকচিক্যে ভাটা পড়েছিল। পথের ধুলো-বালিতে বদলে গিয়েছিল রঙ। দূর থেকে মিনার না দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটি মসজিদ। বাংলার প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বাক্ষী এই মসজিদের কোলঘেঁষে সমাহিত ‘জাগো বাহে কোনটে সবায়’ খ্যাত নুরুলদীনের কবরটাও ছিল দৃষ্টির আড়ালে। সম্প্রতি ২০০ বছরের পুরোনো মসজিদের সংস্কার  করায় তা হয়ে উঠেছে দৃষ্টিনন্দন।

বহু বছর ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকা মসজিদটির নতুন রঙ যে কারও মন কাড়বে। মসজিদের সংস্কারসহ নুরুলদীনের সমাধি ও আশপাশের আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। সাদা রঙের ছোঁয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের নজর কাড়ছে মসজিদটি।

বলছিলাম মোঘল আমলে নির্মিত ফুলচৌকি মসজিদের কথা। এটি বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনার একটি। উত্তরের বিভাগীয় জেলা রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ময়েনপুর ইউনিয়নের ফুলচৌকি গ্রামে অবস্থিত। ২০০ বছর আগে খাদেম বাকের মোহাম্মদ কামাল  মসজিদটি নির্মাণ করেন। গ্রামের নামেই মসজিদটির নামকরণ করা হয়।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ফুলচৌকি মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হলেও দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার হয়নি। এ কারণে মসজিদটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল। সম্প্রতি মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্ব নিয়েই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা মসজিদের সংস্কার কাজ করেছেন ফাতেমাতুজ জোহরা। এখন ইউএনও’র মমতায় নুরুলদীনের রাজধানীর প্রাচীন এই মসজিদটি যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এ মসজিদটির দেয়ালজুড়ে আছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। দূর থেকে যতটা না সুন্দর দেখায়, তার চেয়েও বেশি সুন্দর কাছে থেকে দেখতে। মসজিদটি আয়তকার এবং প্রতিটি কোণায় গোলাকার কিউপলা যুক্ত স্তম্ভ রয়েছে। যার নিচের অংশ কলসাকৃতি। মসজিদের সামনে খোলা অঙ্গন (সাহান) অনুচ্চ প্রাচীর বা বেষ্টনী দ্বারা আবৃত।

মসজিদের প্রবেশদ্বারের পূর্বপাশ ঘেঁষে একটি পরিকল্পিত ফুল বাগান ছিল। বাগানটিতে সৌন্দর্যময় স্থাপত্য রাখা হয়েছিল। বর্তমানে স্থানীয়রা সেই জায়গাটি কবরস্থান হিসেবে ব্যবহার করছে। মসজিদের পাশে ইমামের থাকার জন্য মিনার বিশিষ্ট একটি কক্ষ বা ঘরও আছে।

এই মসজিদ প্রাঙ্গণে শায়িত আছেন বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রাণপুরুষ শহীদ নবাব নুরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। তিনি দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের (দ্বিতীয়) আপন চাচাতো ভাই ও ভগ্নিপতি। ইংরেজ শাসন উৎখাতে তিনি ১৭৬০ থেকে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

জমিদারির লোভে ‘দিবা ও নিশি’ নামে দুই বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে নুরুউদ্দিন বর্তমান লালমনিরহাটের আদিতমারীর মোগলহাটে বৃটিশ সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমণে আহত হন। আহত অবস্থায় তাকে তার নির্মাণাধীন রাজধানী ফুলচৌকিতে নেওয়া হয়। আহত অবস্থায় ১৭৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ফুলচৌকির নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন তিনি।

ফুলচৌকি মসজিদ চত্বরের কবরস্থানে আরও অনেক যোদ্ধার সঙ্গে ঘুমিয়ে আছেন রংপুরের একজন ঐতিহাসিক ও নবাব নুরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জংয়ের বংশধর হায়দার আলি চৌধুরী। তার বিখ্যাত ইতিহাস খ্যাত অতিমূল্যবান বই ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’।

ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ফুলচৌকি মসজিদটি রংপুর শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দক্ষিণে মিঠাপুকুরের গড়েরমাথা নামক স্থান হয়ে পশ্চিম দিকে বিরামপুর-দিনাজপুর সড়কে ময়েনপুর ইউনিয়নের শুকুরেরহাট হয়ে সেখান থেকে আরও ২ কিলোমিটার পশ্চিমে ফুলচৌকি গ্রামে অবস্থিত।

ফুলচৌকি গ্রামের কৃষক সুলতান মিয়া বলেন, ‘আমরা জন্মের পর থেকে এই মসজিদ দেখে আসছি। বাপ-দাদারাও দেখেছেন। মসজিদটি ২০০ বছরের পুরোনো হলেও দীর্ঘদিন ধরে কোনো সংস্কার হয়নি। কিছু দিন আগে নতুন ইউএনও মসজিদের সংস্কার কাজ করেছেন। এখন মসজিদটা দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে। শহরের মানুষজনও মসজিদ দেখার জন্য গ্রামে এসে ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বেশি বেশি প্রচার হওয়া দরকার, তাহলে সরকার এই মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণ করবে।

স্থানীয় ময়েনপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে এখানে সরকারিভাবে একটি সাইনবোর্ড টাঙানো রয়েছে। এছাড়া সরকারিভাবে মসজিদটির সংস্কারের কোনো বরাদ্দ আসেনি। এলাকাবাসীরা মিলে মসজিদটি পরিচালনা করা হচ্ছে। সম্প্রতি নতুন ইউএনও মসজিদ পরিদর্শন করেছেন। তার (ইউএনও) সহযোগিতায় নুরুলদীনের কবরটি চিহ্নিত করে সংস্কার ও রঙ করা হয়েছে। এটি যথাযথভাবে সংস্কার ও সংরক্ষণ করে প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো হলে দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসবে।

ইউএনও আরও বলেন, মসজিদে নিয়মিত নামাজ হয়। ভেতরে দুই কাতার এবং বাইরে ত্রিপল টাঙিয়ে চার কাতার পর্যন্ত মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। মসজিদে যাওয়ার রাস্তাটিও কাদাপানিতে ভরা। সেখানে একটি রাস্তা করার সুযোগ রয়েছে। আমরা চেষ্টা করব একটা রাস্তা নির্মাণের।