জালালাবাদ গ্যাসের বকেয়া সাড়ে আটশ কোটি টাকা

জালালাবাদ গ্যাসের বকেয়া সাড়ে আটশ কোটি টাকা

দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস টি অ্যান্ড টি সিস্টেম লিমিটেড পাবে ৮৪৯ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মহামারি করোনার কারণে বিল আদায় কার্যক্রমে গতি আনতে পারছে না তারা।

এদিকে দিনের পর দিন গ্যাস খাতে বিল বকেয়া থাকায় গ্রাহকদের কাক্সিক্ষত সেবা দেওয়া যেমন ব্যহত হচ্ছে, তেমনি বিতরণ সংস্থাগুলো লোকসানের দিকে এগোচ্ছে। র্দীঘ সময় ধরে গ্যাস বিল এভাবে বকেয়া পড়ে থাকলে কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জ্বালানি সংশ্লিষ্টরা।পাশপাশি গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস টি অ্যান্ড টি সিস্টেম লিমিটেড, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড- এই ছয় কোম্পানি দেশে গ্যাস সরবরাহ করে থাকে। এই ছয় কোম্পানি দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির কাছে গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত ৯ হাজার ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা গ্যাস বিল পাবে। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাওনা ১ হাজার ৬৪৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

সূত্র জানায়, সরকারি ও বেসরকারি উভয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ, ক্যাপটিভ পাওয়ার, সার কারখানা, শিল্প, বাণিজ্যিক, আবাসিক, সিএনজি ফিড গ্যাস এবং চা বাগান এই সাত শ্রেণির গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিল বকেয়া। এর মধ্যে গত এপ্রিল পর্যন্ত তিতাস গ্যাস গ্রাহকদের কাছে পাবে ৬ হাজার ৩১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা, জালালাবাদ গ্যাস টি অ্যান্ড টি সিস্টেম লিমিটেড পাবে ৮৪৯ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টাকা, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড পাবে ৭৭০ কোটি ১০ লাখ টাকা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের পাওনা ৮২৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড পাবে ২১১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড গ্রাহকের কাছে পাবে ১১৩ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

পেট্রোবাংলার সূত্রানুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি খাতের গ্রাহকদের কাছে ৯ হাজার ১৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বকেয়া জমেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া রয়েছে ২ হাজার ৩৭৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। আর সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ৭৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বকেয়ার পরিমাণ ১ হাজার ২৮৭ কোটি ৬ লাখ টাকা। ক্যাপটিভ পাওয়ার ব্যবহারকারীদের কাছে পাওনা ১ হাজার ৬৩৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বকেয়ার পরিমাণ ৪৪২ কোটি ৩ লাখ টাকা আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ১৯৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা। সার কারখানাগুলোর কাছে পাওনা ২১৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের ১১৩ কোটি ৪৫ লাখ আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ১০৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা। শিল্প খাতে বকেয়া ১ হাজার ৪৭০ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা ১১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা এবং বেসরকারি শিল্প কারখানার কাছে ১ হাজার ৪৭০ কোটি ১১ লাখ টাকা। বাণিজ্যিক খাতে বকেয়া ১৮৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ৭ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ১৭৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা। আর আবাসিক খাতে পাওনা রয়েছে ২ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ২৮০ কোটি এবং বেসরকারি পর্যায়ে ২ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। সিএনজি ফিড গ্যাস এবং চা বাগান মালিকদের কাছে পাওনার পরিমাণ ৮২৪ কোটি টাকা বকেয়া। বর্তমানে এই বকেয়ার আদায়ের পরিমাণ গড়ে ২৫ শতাংশ। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বকেয়া তিতাসের। গত এপ্রিল পর্যন্ত গ্রাহকদের কাছে তিতাস গ্যাসের পাওনা ৬ হাজার ৩১৫ কোটি ৪৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।

এ প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিসটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি গ্রাহক তিতাসের। সেদিক থেকে বকেয়া বিলের পরিমাণও বেশি।’ বিল আদায় কার্যক্রম চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৬২৯ কিলোমিটার অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এছাড়া করোনার মধ্যেও গত অর্থবছরের তিতাস শতভাগ রাজস্ব আদায় করতে পেরেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার জোরেশোরে এ কার্যক্রম শুরু হবে।’

এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, গ্রাহকদের কাছে গ্যাস কোম্পানিগুলোর পাওনার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছেই। এছাড়া পাওনা যে পরিমাণ আদায় করা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি বকেয়া পড়ে যাচ্ছে। এবার মহামারি করোনার কারণে এই পদক্ষেপ আরও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্যান্য সময় শিল্প-বাণিজ্যে গ্যাসের বিল বকেয়া থাকলেও এবার কোভিড-১৯ এর কারণে আবাসিকেও বকেয়া বাড়ছে। অনেক গ্রাহক মাসের পর মাস গ্যাস বিল পরিশোধ করছেন না। বিল আদায় প্রক্রিয়া নানাভাবে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এভাবে চলতে থাকলে গ্যাস কোম্পানিগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। কারণ সরবরাহ করা গ্যাসের একটা বড় অংশ আমদানি করা হয়। গ্রাহকরা বিল পরিশোধ না করলে এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।

পেট্রোবাংলার উপ ব্যবস্থাপক (হিসাব) সজল চন্দ্র দাশ বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে এমন বকেয়া সব সময়ই থাকে। কখনোও পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব হয় না। শিল্প-বাণিজ্যে বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে। দুই শতাধিক কল কারখানার কাছে গ্যাস বিল বকেয়া। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও র্দীঘদিন বকেয়া রয়েছে। একদিকে পাওনা কিছু করা গেলেও অন্যদিকে বকেয়ার পরিমাণও বাড়তে তাকে। যে কারণে বিলের এই পরিমাণ খুব বেশি নড়চড় হয় না । এদিকে এই গ্যাস বিলের বকেয়া আদায়ে উদ্যোগ নিয়েছে খোদ জ্বালানি বিভাগ। বিতরণ কোম্পানিগুলোকে খেলাপি গ্রাহকদের তালিকা তৈরি করতে গত জানুয়ারিতে নির্দেশ দেয় সংস্থাটি জ্বালানি বিভাগ।

জ্বালানি বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিসুর রহমানের সই করা ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, এই তালিকা তৈরির পর মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন), অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সন্বয়ে গঠিত কমিটি গ্যাস বিল বকেয়া আদায় এবং পরিশোধ না করলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করনের কাজ দেখভাল করবেন। সেইসঙ্গে এই কমিটি অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও গ্যাস পাইপলাইন অপসারণ কার্যক্রম তদারক করবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটি সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, নির্দেশনা অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অবৈধ গ্যাসলাইন বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে এবং বিল আদায়ও করা হয়েছে। কিন্তু গত এপ্রিল থেকে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় এই কার্যক্রম অনেকটাই থেমে রয়েছে।