দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমার কথাগুলো কি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাবে? 

দুর্ভিক্ষ নিয়ে আমার কথাগুলো কি কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাবে? 

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায় এর জন্য দায়ী ছিল — ধানের বাদামী দাগ রোগ এবং ঘূর্ণিঝড়। এই দুই কারণে ওই বছর খাদ্য উৎপাদন কম হয়। কিন্তু নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর এক গবেষণায় দেখান শুধুমাত্র এই দু’টি কারণে এতো প্রকোটভাবে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় নি। তাঁর মতে, মানবসৃষ্ট কারণেই মূলত এই কঠিন সময়ের দেখা দিয়েছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি যে বিষয়গুলো তুলে ধরেন তা হলো–

প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যাতে ব্রিটিশ ভারতকে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য ব্রিটিশরা চট্টগ্রাম বন্দরের মতো জায়গার জাহাজ নষ্ট করে ফেলে। এসময় তারা ছোট নৌকা এমন কি গরুর গাড়িও ধ্বংস করে ফেলে। যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে যায়।  তাই বিভিন্ন অঞ্চলে সঠিক সময়ে খাদ্য পৌঁছানো সম্ভব  হয়নি। দ্বিতীয়ত, বারমা ছিল ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম চাল আমদানিকারক দেশ। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপান বারমাকে আক্রমণ করায় বারমা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ দেখা দেয় এমন বিভীষিকাময় সময়। ২.১ থেকে ৩ মিলিয়ন মানুষ এই সময়কালে খাদ্যের অভাবে মারা যান। 

বর্তমানে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে৷ আমাদের দেশেও অকটেলের মূল্য ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ডিজেলের মূল্য বেড়েছে প্রতি লিটারে ১১৪ টাকা। যার ফলে যাতায়াত ও পরিবহন খরচ আনুপাতিক হারে বেড়েই চলেছে। সেই সাথে পেয়াজের মূল্য ৬০%, মরিচের মূল্য ৬৬%, মুরগির দাম ৭০%, ফিডের মূল্য ৪০% বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও আটার মূল্য প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা ও এলপি গ্যাসের দাম কেজি প্রতি ২২৬ টাকা বেড়েছে। 

এই মূল্য বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন— যে সকল পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, সে সকল পণ্যের আমদানি শুল্ক কম নির্ধারণ করার জন্য সরকারের তরফ হতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ভোক্তার সুবিধার্থে সরকার বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। তবে মাঠ পর্যায়ের বাজারগুলোতে পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত মূল্য অনুসরণ করা হচ্ছে না। অধিক দামে পণ্য বিক্রয়ের কারণ হিসেবে বড় বাজারিরা বলছেন, যোগান কম থাকায় মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে।

এই যোগান কম থাকার কারণ হিসেবে বলা যায় বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট এবং খাদ্যসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি। খাদ্য সংকটের ফলস্বরূপ বিশ্বের অনেক দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিও এর কবলে পড়তে পারে বলে অনেকে আশংকা করছেন। আগাম সতর্কবার্তা হিসেবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ তিনি এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন যাতে আমরা  দুর্ভিক্ষের কবল থেকে বাঁচতে পারি। কিন্তু আমরা সে অনুযায়ী কাজ না করে খারাপ সময়ের জন্য অপেক্ষা করছি যেন দুর্ভিক্ষ আসলে পথে ঘাটে মরে পড়ে থাকা লাশের ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে বলতে পারি— “দেখুন সরকার দেশের কি অবস্থা করেছে।” 

তবে সেদিনের দায় সরকারের একার নয় বরং তা হবে আমাদের সকলের। তাই আমরা যদি এখনই একতার সাথে দেশের জন্য কাজ করতে পারি, তাহলে অন্ধকার নামার আগে নতুন আলোর সন্ধান পাবো। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।  যেমন— দেশের ৮,৫৩,২৬৭ জন স্নাতক পর্যায়ের  শিক্ষার্থীর পাঠ্যক্রমে কৃষিকে একটি কোর্স হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং এই কোর্সে তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দেশের কৃষিকাজে মানবসম্পদের একটি বড় অংশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে আমাদের কৃষিতে নতুন কিছু আবিষ্কারের সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনি আমাদের দেশে কৃষি বিপ্লবও ঘটতে পারে। 

এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে থাকা অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনা যেতে পারে। এর পাশাপাশি আমাদের দেশে এমন অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি আছে যা বছরের পর বছর খালি পড়ে থাকে। সরকার একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে এ ধরনের জমির সন্ধান করতে পারে এবং জমির মালিক হতে স্বল্প মূল্যে সেই জমি ভাড়া নিয়ে তা চাষের আওতায় নিয়ে আসতে পারে। এতে করে যেমন খাদ্য উৎপাদন বাড়বে তেমনি দেশের অর্থনীতি আরও সচল হবে। আসন্ন দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় আমার এই ছোট্ট চিন্তা যদি দেশের কোনো উপকারে আসে, তাহলে দেশের জন্য আমার জীবনের একটি লক্ষ্য পূরণ হবে।

লেখক: সুমাইয়া চৌধুরী, অর্থনীতি বিভাগ, ১ম বর্ষ ২য় সেমিস্টার, শাবিপ্রবি।