সেই আতিয়া মহলে এখন প্রাণচাঞ্চল্য

সেই আতিয়া মহলে এখন প্রাণচাঞ্চল্য

সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি এলাকার আতিয়া মহল নামক পাঁচতলা আবাসিক ভবনটি ছিলো প্রাণবন্ত। ৪২টি পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন সে বাড়িতে।

২০১৭ সালে আকস্মিক জঙ্গিবিরোধী এক অভিযানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বাড়িটির একাংশ। সিলেটের আতিয়া মহল নিয়ে আলোচনা হয় দেশ-বিদেশে। তবে সংস্কার কাজের পর ফের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে ভবনটিতে। নতুনদের পাশাপাশি পুরোনো ভাড়াটিয়াদের অনেকে ফিরেছেন ভবনে।

আতিয়া মহলের জানালা, দরজা, গ্রিল, দেয়াল মেরামত করা হয়েছে, পড়েছে রংয়ের প্রলেপ। বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া প্রধান ফটকটি পড়ে আছে ভবনের একপাশে। ফটক ছাড়া পুরোনো সব ক্ষতই এখন অদৃশ্য।

আতিয়া ভবনের একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গি রয়েছে- এমন তথ্যে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ রাতে শুরু হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান। পুলিশ-র‍্যাবের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর টিম যোগ দেয় এ অভিযানে। টানা ১১১ ঘণ্টা অভিযানের পর আতিয়া মহল থেকে উদ্ধার করা হয় জঙ্গি পরিচয়ের চারজনের মরদেহ। সে সময়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটে।

এ ঘটনায় র‌্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, দুই পুলিশ সদস্যসহ মোট ৭ জন নিহত হন। অভিযানে গুলি ও বোমার বিস্ফোরণে আতিয়া মহল ক্ষতিগ্রস্ত হয় চরমভাবে।

আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর দুটি মামলা হয়। যার তদন্ত স্থানীয় থানা পুলিশ শুরু করলেও পরে তা স্থানান্তর হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর কাছে। ২০১৯ সালে একটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়। অন্যটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই।

বিস্ফোরণের মামলায় আদালতে দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রেনেড হামলার হোতা ছিল তিনজন। পৃথক অভিযানে তারা সবাই নিহত হওয়ায় মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে। এই ঘটনায় বিচারের মুখোমুখি করার মতো আসামি কেউ নেই।

আরেক মামলায় আত্মঘাতী জঙ্গি মর্জিনা খাতুনের ভাই জহুরুল হক, ভাবি আর্জিনা ওরফে রাজিয়া সুলতানা ও হাসান নামে তিনজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তিন আসামিই কারাগারে আছেন।

এই মামলাটি সিলেট মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন বলে জানিয়েছেন সিলেটের সরকারি কৌঁসুলি নিজাম উদ্দিন।

 নতুন করে আতিয়া মহলে উঠা বাসিন্দাদের মধ্যে কয়েকজন জানান, দীর্ঘ সময় পরও তাদের তাড়িত করে ২০১৭ সালের ২৩ মার্চের ভয়াল স্মৃতি। তবে নতুন ভাড়াটিয়ারা অনেকে জানেন না সে সময়ের ঘটনা। পুরোনো ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ৪টি পরিবার ফিরেছে এ ভবনে।

আতিয়া মহলের মালিক উস্তার মিয়া থাকেন পাশের আরেকটি বাড়িতে। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের পর তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর জিঙ্গাসাবাদের মুখে পড়তে হয়েছে কয়েক দফায়। বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত ভবন নিয়ে ছিলেন উদ্বিগ্ন।

উস্তার মিয়া বলেন, ‘ঘটনার প্রায় ৩ মাস পর ভবনটি বুঝিয়ে দেয়া হয়। তখন ভবনটি অনেকটা ধ্বংসস্তূপের মতো ছিল। এরপর প্রায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করেছি।

‘আগেও সব ভাড়াটিয়ার ভোটার আইডির ফটোকপিসহ তথ্য রাখতাম, এখন আরও সতর্ক। ভালোভাবে যাচাই না করে ভাড়াটিয়া তুলছি না। থানাতেও জমা দেয়া হয় তাদের তথ্য। ঘটনার পর থেকে পুলিশের টহল বেড়েছে আতিয়া মহলের চারপাশে।’

এদিকে, আতিয়া মহলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে গত ২৫ মার্চ সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের পুলিশ সুপার (এম এন্ড সিএ) জেদান আল মুসা তাঁর নিজস্ব ফেসবুকে একটি লেখা লেখেন।

ভয়াবহ সেই দিনটির কথা তুল ধরে তিনি লেখেন- ‘আজ সিলেটের আতিয়া মহলের দুঃসহ স্মৃতির ৫ বছর।
২০১৭ সালের ২৫ মার্চ। সিলেটের শিববাড়ীর পাঠানপাড়া এলাকায় আতিয়া মহলে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার কথা মনে হলে এখনও শিউরে উঠি। ২৫মার্চ সন্ধ্যায় জঙ্গিদের হামলায় জীবন উৎস্বর্গ করেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের দুইজন পুলিশ অফিসার ও র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং এর মেজর আজাদ। ঘটনায় চারজন সাধারন নাগরিক নিহত হন। তাদের সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহপাক তাঁদের জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন।

 মোগলাবাজার থানার পাঠানপাড়া-২৭ নং ওয়ার্ডর উস্তার আলী’র বাসায় জঙ্গি আছে মর্মে তথ্যের ভিত্তিতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া স্যারের নির্দেশে অভিযান পরিচালনা করা হয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে সিলেট মহানগর পুলিশ ২৪ মার্চ রাত অনুমান ০২.০০ ঘটিকা হতে বাসাটির চারপাশে ঘিরে রাখে। সেই সময় আমি অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) হিসেবে কর্মরত ছিলাম এবং ঘটনাটি আমার দায়িত্বধীন এলাকায় হওয়ায় আমাকে পুরো অপারেশন প্ল্যান প্রস্তুত করতে হয়েছিল। নির্ঘূম রাত শেষ হয়েছিলো ঘটনাস্থল পরিদর্শন, পর্যাবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ ও সামগ্রিক কার্যাক্রমের মাধ্যমে। এরই মধ্যে জঙ্গিরা তাদের অবস্থান নিশ্চিত এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য সকাল অনুমান ০৮.৩০ ঘটিকার সময় “আল্লাহু আকরা” ধ্বনি দিয়ে বিকট শব্দে একটি বোমা নিক্ষেপ করে তাদের অবস্থান জানান দেয়। তখন আমরা আতিয়া মহলের আশেপাশের বিল্ডিংয়ের লোকজন সরিয়ে নিই। জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য থাকায় সাময়িক ভাবে অভিযান স্থগিত রেখে পুলিশ বাড়িটির চারিদিক ঘিরে রাখে এবং সাহায্য চায় বিশেষায়িত ইউনিটসমূহের কাছে।

ঢাকা হতে সন্ধ্যার মধ্যে সোয়াট টিমের সদস্যরা সিলেট এসে পৌছায়। তারা ঘটনাস্থল রেকী করে অপারেশন প্ল্যান প্রস্তুত করে।২৫মার্চ সন্ধ্যা আনুমানিক ৬:৩০ ঘটিকার সময় জঙ্গিদের হামলায় নিহত হন সাধারণ চার জন নাগরিক। ৭:৪৫ ঘটিকার সময় জঙ্গিদের আরেকটি বোমায় আঘাতে নিহত হন পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও চৌধুরী মো: আবু কয়সর এবং র‍্যাবের মেজর আজাদ। ঘটনাস্থলে আমি অবস্থান করছিলাম। চৌধুরী আবু কয়সর ও ইন্সপেক্টর মনিরুল ও ইন্সপেক্টর সোহেল আমার পাশেই ছিলেন। একটু দূরে ছিলেন এসআই জনি লাল দে ও এস আই পারভেজ এবং তৎকালীন সময়ের দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি ইন্সপেক্টর হারুন, এসি কোতয়ালি দস্তগীরসহ অনেকে।

বোমার বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে গোটা শিববাড়ি। ২৬মার্চ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে আতিয়া মহলের সমস্ত জঙ্গিদের আস্তানা নির্মূল করা হয়। অভিযানের মাধ্যমে মোট ৭৮ জন সাধারণ নাগরিককে বিল্ডিংয়ের মধ্যে থেকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয় এবং ০২ জন জঙ্গী নিহত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে আরও ০৪ জন জঙ্গীকে নির্মুল করার মাধ্যমে অভিযানের কার্যক্রম সমাপ্ত হয়।

উক্ত ঘটনায় মোগলাবাজার থানায় দুটি মামলা রুজু হয়েছিলো। এসি মোগলাবাজার জ্যোতির্ময় সরকার, এসি ইসমাঈল, এডিসি গোপাল বাবু, এসি জুবায়ের, ওসি খাইরুল ফজল, ইন্সপেক্টর সঞ্জিতসহ অনেক পুলিশ অফিসার ও ফোর্স সেই সময় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তাদের ধন্যবাদ জানাই। পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া স্যারের বলিষ্ঠ ভূমিকার ফলে সেদিন জঙ্গিদের নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিলো। সাহসী ভূমিকা ছিলো উপ পুলিশ কমিশনার রেজাউল স্যার, বাসুদেব স্যার, ফয়সল স্যার, শামীম স্যার, তোফায়েল স্যার এর। অতিরিক্ত কমিশনার রোকন স্যার খুব কাছে থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করেছেন। সকল স্যারদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আজ করোনার আতঙ্কে হতোবা ব্যস্ততায় আমরা ভুলে ভুলে গিয়েছি নিহত পুলিশ অফিসারদের আত্মত্যাগের কথা। তাঁদের পরিবার কেমন আছেন? আহতরা বা কেমন আছেন? আমরা ভুলে গেছি কিন্তু নিহতদের পরিবার স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে আজও বেঁচে আছে। বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জীবন উৎস্বর্গকারী বীরদের। স্যালুট।’