সুনামগঞ্জে দলীয় কোন্দলে আওয়ামী লীগ, আন্দোলনে চাঙা বিএনপি
সম্মেলনের ৯ মাস পর সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হলো ৯ সেপ্টেম্বর। এই কমিটিতে দলে নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হয়। এতে হতাশ হয় একটি পক্ষ। জেলার পাঁচটি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের নিয়ে তলে–তলে পক্ষ-বিপক্ষ থাকলেও এই মুহূর্তে দল গোছানোকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন নতুন কমিটির শীর্ষ দুই নেতা।
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টায় আছে বিএনপিও। পাঁচ বছর আগেও এখানে বিএনপি ছিল তিন ভাগে বিভক্ত। দল ক্ষমতায় না থাকা এবং ভেতরে-বাইরে নানা চাপে এই বিভক্তি আস্তে আস্তে মিটে গেছে। এখন ‘ঐক্যবদ্ধ’ বিএনপির নেতাদের চোখ কেন্দ্রের দিকে। আপাতত নির্বাচনের চেয়ে তাঁরা ব্যস্ত কেন্দ্র–ঘোষিত আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে।
বড় দুই দলের বাইরে সুনামগঞ্জে জাতীয় পার্টি (জাপা) নিয়ে কিছুটা আলোচনা আছে। এই আলোচনা দল ছাপিয়ে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) টানা দুইবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য জেলা জাপার আহ্বায়ক পীর ফজলুর রহমানকে (মিসবাহ) নিয়ে। গত ১০ বছর তিনি নানা ইস্যুতে সংসদে যেমন সরব ছিলেন, একইভাবে ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন।
আওয়ামী লীগে ত্যাগ বনাম বঞ্চনা
গত ১১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে নূরুল হুদা (মুকুট) ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নোমান বখতের (পলিন) নাম ঘোষণা করা হয়। ছয় বছর দায়িত্ব পালনের পর সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বাদ পড়েন এনামুল কবির (ইমন)।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের টানা দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান নূরুল হুদা ১৫ বছর জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ছয় বছর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর ছোট ভাই খায়রুল হুদা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত গত কমিটিতে সহসভাপতি ছিলেন। তাঁর বড় ভাই জেলা কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সুনামগঞ্জের মেয়র আয়ুব বখতের মৃত্যুর পর তাঁকে সহসভাপতি করা হয়েছিল। তাঁর আরেক বড় ভাই সুনামগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র নাদের বখত নতুন কমিটিতে সহসভাপতি।
এনামুল কবির একসময় জেলা পরিষদের প্রশাসক ছিলেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুনামগঞ্জ-৪ আসনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে আসনটি মহাজোটের শরিক জাপাকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তাঁর দুই ভাই ফজলুল কবীর গত কমিটিতে সদস্য ও খায়রুল কবীর সহসভাপতি ছিলেন। এনামুল কবির সাধারণ সম্পাদক থেকে বাদ পড়ায় হতাশ তাঁর পক্ষের নেতারা। তাঁদের আশা ছিল, পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অনেকেই স্থান পাবেন; কিন্তু সেটিও হয়নি। এনামুলকে সহসভাপতি রাখা হলেও আগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে থাকা ১৪ নেতার স্থান হয়নি নতুন কমিটিতে।
আবার এই তিন নেতার সঙ্গে না থাকা অনেকেরই স্থান হয়নি নতুন কমিটিতে, যাঁরা ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ করে আওয়ামী লীগে সক্রিয়। জেলা কমিটিতে পদ না পাওয়া তিনজন নেতার ভাষ্য, জেলায় পদ পেতে হলে বা সক্রিয় রাজনীতি করতে হলে, কোনো না কোনো নেতার পক্ষে থাকতে হবে। না হলে পদ পাওয়া কঠিন। কোনো কর্মসূচিতে ডাক পাওয়া যাবে না। এ কারণে অনেকেই আজ নিষ্ক্রিয়। এতে দল দুর্বল হচ্ছে। তাঁদের একজন আক্ষেপ করে বলেন, ‘নেতাদের সঙ্গে দুর্দিনে মাঠে থেকেছি। আমাদের জন্যই আজ তাঁরা নেতা। অথচ তাঁদের কাছেই আমরা মূল্যায়ন পাইনি।’
নতুন কমিটিতে আবার দীর্ঘদিনের পদবঞ্চিত, ত্যাগীরাও স্থান পেয়েছেন। তাঁদের একজন জীতেন্দ্র তালুকদার। জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এই সভাপতি বলেন, ‘জেলা কমিটিতে স্থান পাব, এই আশা তো ছেড়েই দিয়েছিলাম। এবার নতুন সভাপতি ও সম্পাদক বলতে গেলে তৃণমূল থেকে আমাদের খুঁজে এনে কমিটিতে পদ দিয়েছেন।’
তবে শুধু এনামুল কবিরের পক্ষে থাকায় কমিটিতে পদ দেওয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গত কমিটির দপ্তর সম্পাদক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকী। এনামুল কবির বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘ছয় বছর দিনরাত পরিশ্রম করে সংগঠনকে একটি শক্ত অবস্থানে এনেছি আমরা। যাঁরা দলের জন্য এই শ্রম দিয়েছেন, তাঁদের মূল্যায়ন করা উচিত ছিল।’
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করতেই দল গোছানোর কাজ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন নোমান বখত। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রাণ হচ্ছে তৃণমূল। আমরা তৃণমূল থেকে নেতাদের এনে কমিটিতে স্থান দিয়েছি। এতে সবাই খুশি।’
জেলা আওয়ামী লীগে এখন আর কোনো বিভেদ নেই দাবি করে নূরুল হুদা বলেন, নতুন কমিটির নেতৃত্বে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে সুনামগঞ্জের পাঁচটি আসনেই নৌকার বিজয় হবে।
আন্দোলনে চাঙা বিএনপি
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের পর জেলা বিএনপি শহরের পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে বন্দী হয়ে পড়ে। সেখানে থাকা দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে আলফাত স্কয়ার অভিমুখে তিন-চার মিনিট হাঁটলেই পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। এরপর সেখানেই দু–একজন সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করে কর্মসূচি শেষ। তবে এই ‘বন্দিদশায়’ থেকেও কেন্দ্র–ঘোষিত প্রায় সব কর্মসূচিই পালনের চেষ্টা করেছেন দলের নেতারা। শহরে প্রচার আছে, পুলিশের সঙ্গে বিএনপির এ নিয়ে একধরনের সমঝোতা ছিল। তাই বিএনপি এই সীমার বাইরে যেতে চায়নি। কিন্তু মাস দুয়েক হয় সেই ‘বন্দিত্ব’ থেকে বিএনপি বেরিয়ে এাসেছে। ঢাকায় মহাসমাবেশের পর নেতা–কর্মীরা কয়েকটি কর্মসূচি করেছেন শহরের নতুন বাস টার্মিনাল থেকে শুরু করে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। জেলা নেতাদের ‘ঐক্যে’ বিএনপি এই শক্তি পেয়েছে বলে মনে করেন সংগঠনের অনেকে।
জেলা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় তিন ভাগে বিভক্ত ছিলেন নেতারা। এখন সেটি ঘুচেছে। নেতারা এক কার্যালয়েই প্রতিদিন বসছেন। সংগঠনে নেতৃত্বের কোনো দ্বন্দ্ব-দূরত্ব নেই। প্রায় এক বছর ধরে সবাই একসঙ্গেই কর্মসূচি পালন করছেন। নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে।
জেলা বিএনপির সহসভাপতি আবুল মনসুর মোহাম্মদ শওকত বলেন, নেতা-কর্মীরা নানাভাবে হয়রানি, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ঢাকার সর্বশেষ মহাসমাবেশ থেকে ১০ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা আছে। তাঁরা এখন আন্দোলনকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম বলেছেন, এখন অন্য কোনো কিছু ভাবার সময় নেই। সামনে পথ একটাই, সেটি হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এটা আন্দোলনের মাধ্যমেই নিশ্চিত করতে হবে।
এখন বিএনপির ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্র একই সুতায় বাঁধা বলে মন্তব্য করেন জেলা কমিটির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘জনতার শক্তিও আমাদের সঙ্গে। আমাদের কোনো দুর্বলতা নেই। আমাদের আন্দোলনের যে লক্ষ্য, তার কাছাকাছি আছি আমরা।’
নির্বাচনী আলোচনায় জাপা
সুনামগঞ্জ-৪ আসন ছাড়া জাতীয় পার্টি নিয়ে জেলার অন্য কোথাও খুব একটা আলোচনা নেই। এই আসনে টানা দুবার মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য হয়েছেন পীর ফজলুর রহমান। তিনি নির্বাচন মাথায় রেখে এলাকায় কাজ করেছেন। মাঠেই আছেন।
তবে এই আসনে নৌকার দলীয় প্রার্থী চায় আওয়ামী লীগ; কিন্তু জাপা আসনটি ছাড়তে নারাজ। প্রয়োজনে এককভাবে লাঙল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করারও প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে বলে জানান জেলা জাপার সদস্যসচিব ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন।
পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে জাতীয় সংসদ এবং মাঠে সক্রিয় আছি। নির্বাচনী এলাকার দুই উপজেলার প্রতিটি ওয়ার্ডে সংগঠনের কমিটি করেছি। এখানে জাপা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। এটি বিগত ইউপি নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে। এই দুই উপজেলার ইউপিতে জাপার প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কয়েকটিতে জয়লাভ করেছেন। জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি।’ -সৌজন্য: প্রথমআলো